কৈবর্ত বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল:


পালরাজ দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে (১০৭০-৭৫ খ্ৰীঃ) জনৈক দিব্য বা দিবোক - এর নেতৃত্বে বরেন্দ্র অঞ্চলে এক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। এই বিদ্রোহ ‘কৈবর্ত বিদ্ৰোহ’ নামে খ্যাত।

উপাদান:
সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত’ গ্রন্থে এই বিদ্রোহের বিস্তারিত বিবরণ আছে। এছাড়া বৈদ্যদেবের কামাউলী পট্ট মদনপালের 'মানহালি দানপত্র' এবং উপাদান ভোজবর্মনের বেলবা দানপত্রেও এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়।

কৈবর্ত বিদ্রোহের কারণ:
কৈবর্ত বিদ্রোহের কারণ সম্বন্ধে একাধিক মত প্রচলিত আছে।

ড. এস. পি. লাহিড়ীর মতে, চাষী-কৈবর্তশ্রেণীভুক্ত যশোদাস নামক জনৈক ব্যক্তি রাজ্যপালের মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। ফলে কৈবর্তদের রাজনৈতিক প্রাধান্য সূচিত হয়েছিল। এরই পরিণতিতে বিদ্রোহের মাধ্যমে কৈবর্তরা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপনে সচেষ্ট হয়েছিল।

পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, কৈবর্তরা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপনে সচেষ্ট হয়েছিল। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, কৈবর্তরা ছিল বরেন্দ্রের শক্তিশালী জাতি। দ্বিতীয় মহীপালের অত্যাচারে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা দিব্যর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেছিল।

ড. বি. সেন এই বিদ্রোহের সামাজিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তাঁর মতে, বৌদ্ধধর্মে মৎস্য হত্যা নিষিদ্ধ ছিল। ফলে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের আমলে কৈবর্তদের সামাজিক অসুবিধা হচ্ছিল। দ্বিতীয় মহীপাল কঠোরভাবে এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে চাইলে কৈবর্তরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

তবে অনেকে এই তত্ত্ব অস্বীকার করেছেন। এঁদের মতে, পালরাজারা ছিলেন ধর্মবিষয়ে উদার। তাই ধর্মীয় অত্যাচারের সম্ভাবনা ছিল না। সামাজিক বিদ্রোহ সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর ‘রামচরিত’ গ্রন্থে এই বিদ্রোহকে ‘অনিকম্ ধর্মবিপ্লবম্’ বলে বর্ণনা করেছেন। ‘অনিকম্’ অর্থে অপবিত্র। তিনি আরও বলেছেন, রাজবাহিনী ‘মিলিতাক্তক সামস্তচক্রের’ সম্মুখীন হয়েছিল। দিব্য ছিলেন রাজার পক্ষে। সম্ভবত মিত্রের ছদ্মবেশে রাজবাহিনীর সাথে ছিলেন দিব্য। তাঁর আসল লক্ষ্য ছিল রাজসিংহাসন অপবিত্র বিদ্রোহ দখল করা। অর্থাৎ সামন্তদের সাথে রাজার সংঘর্ষ দ্বারা রাজা ও সামন্ত উভয় পক্ষের শক্তি ক্ষয় হবে। সেই সুযোগে রাজক্ষমতা দখল করবেন দিব্য। বাস্তবে দেখা গেছে, দ্বিতীয় মহীপালের নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বারেন্দ্রকে নিজ অধীনে এনেছিলেন। এই অর্থে তিনি অপবিত্র বা অন্যায় আচরণ করেছিলেন।

ড. উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল, যদুনাথ সরকার প্রমুখ এই বিদ্রোহের গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এঁদের মতে, কৈবর্ত - শ্রেণীভুক্ত দিব্য নেতৃত্ব দিলেও এটি কেবলমাত্র কৈবর্তদের বিদ্রোহ ছিল না। বাংলার কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা এবং রাজপরিবারের অন্তর্বিরোধের সুযোগে উত্তরবঙ্গের সামন্তরাজাগণ একত্রে রাজনৈতিক বিদ্রোহ এই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন। দক্ষতা ও যোগ্যতার দ্বারা দিব্য এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল।

ড. মজুমদার অস্বীকার করেন যে, দ্বিতীয় মহীপাল অত্যাচারী ছিলেন না। ব্যক্তিগত উচ্চাশা এবং সমসাময়িক পরিস্থিতিই বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছিল।

কৈবর্ত বিদ্রোহের ফলাফল:
কৈবর্ত বিদ্রোহের ফলও সুদূরপ্রসারী ছিল না। সামন্তরা মিলিতভাবে বিদ্রোহ করলেও খুব শীঘ্র তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। তাই ক্ষমতা পুনদখল করতে রামপালের অসুবিধা হয় নি।

0 মন্তব্যসমূহ