ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কালে ভারতে যে সমস্ত কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ হয়েছিল সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৮৫৫-৫৬ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ। কঠোর পরিশ্রমী শান্তিপ্রিয় ও সরল প্রকৃতির কৃষিজীবী আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাঁওতালরা ব্রিটিশ শাসন ও ব্রিটিশদের আশ্রয়পুষ্ট জমিদার ও মহাজনদের নির্মম শোষনের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল তা 'সাঁওতাল বিদ্রোহ' নামে পরিচিত।
সাঁওতালদের পূর্বকথা:ভারতের আদিবাসী জনজাতিগুলোর মধ্যে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী হলো অন্যতম বৃহৎ জনগোষ্ঠী। ডালটন সাহেবের মতে, সাঁওতালরা বীরভূম অঞ্চলে আসে পূর্ব এবং পশ্চিম দিক থেকে। তারা এসেছিল মূলত চাষবাস ও শিকারের উদ্দেশ্যে। হিন্দু অগ্রগতির চাপে তাদের সমতলভূমি ছেড়ে পার্বত্য অঞ্চলে সরে আসতে হয়। সাঁওতালরা মূলত বৃহৎ দ্রাবিড়ীয় গোষ্ঠীর একটি উপজাতি এবং ভাষাগত দিক থেকে ‘কোলারিয়ান’ শ্রেণির।
দামিন-ই-কোহর ইতিবৃত্ত:
দামিন-ই-কোহ একটি ফারসি শব্দ, যার অর্থ হলো পর্বতের পাদদেশ। এই অঞ্চল বর্তমানে সাঁওতাল পরগণা নামে পরিচিত। বুকানন হ্যামিল্টনের অপ্রকাশিত দলিল থেকে জানা যায় যে, বীরভূম রাজাদের অত্যাচারের ফলে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সাঁওতালরা বীরভূম ত্যাগ করেন এবং গোদ্দা মহকুমা অঞ্চলের বনাঞ্চল পরিষ্কার করে বসবাস আরম্ভ করেন। ১৮৩৬ সালের মধ্যে এইস্থানে প্রায় ৪২৭টি সাঁওতালি গ্রাম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।
বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্ক-ই (১৮২৮-১৮৩৫) সরকারিভাবে রাজমহলের পশ্চিমদিকের জঙ্গল সাফ করে বসবাসের জন্য সাঁওতালদের আহ্বান জানায়। ১৮৫১ সালের মধ্যে এই অঞ্চলের তাদের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩ হাজারে। এ জন্য অবশ্য ইংরেজ সরকারকে রীতিমতো রাজস্ব দিতে হতো তাদের। ১৬/১৭ বছরের মধ্যে ভয়ংকর হারে এই খাজনার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল।
কোম্পানির অত্যাচার, জোরজুলুমের সহযোগী ছিল জমিদার এবং মহাজনরা। সমসাময়িক এক ইংরেজ লেখকের বর্ণনা থেকে জানা যায় মহাজনদের সুদের হার ছিল ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ থেকে ৫০০ শতাংশ। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে শস্য, গবাদি পশু, এমনকি নিজে কিংবা নিজের পরিবারের সদস্যকে আজীবন বিকিয়ে দিতে হয়েছে।
কঠোর পরিশ্রম করেও হাতে কোনো অর্থ থাকত না সাঁওতালদের। চাষের সময় বীজ কিনতে উচ্চ সুদে ধার করা ছাড়া উপায় থাকত না এদের। কঠোর পরিশ্রম করে উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই মহাজন, জমিদার আর পাওনাদারেরা হানা দিত। উৎসব-আনন্দে কিংবা আগামী বছর আবারও মাঠে ফসল ফলিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে ধার-দেনা করতে হয় তাদের। এমনই দুষ্টচক্রে পড়ে কখনো ঘরবাড়ি, কখনো নিজের গবাদিপশু, কখনো নিজেকেই বিকিয়ে দিতে হয় পাওনাদারের কাছে।
১৮৪৮ সালের দিকে মহাজনদের জ্বালায় দামিন-ই-কোহ এলাকার তিনটি গ্রামের সাঁওতাল পরিবার দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তাদের এ অবস্থা দেখে ভগনাডির নারায়ণ মুর্মুর দুই ছেলে সিধু ও কানু বসে থাকতে পারলেন না। অত্যাচারের এই অবর্ণনীয় অবস্থা দেখে প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন দুই ভাই।
সশস্ত্র বিদ্রোহ:
সিধু ও কানু জানতেন সাঁওতাল রাজ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে তাদের অবস্থার মুক্তি হবে না। আর এই মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রয়োজন। তারা সরাসরি বিদ্রোহের ডাক না দিয়ে কৌশলের আশ্রয় নিলেন। তারা এলাকার লোকজনদের জমায়েত করে ঘোষণা করলেন তাদের চার ভাইকে ঠাকুর জিউই স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে নির্দেশ দিয়েছেন অন্যায়-অত্যাচারী জোতদার, মহাজন, জমিদারদের উৎখাত করে সাঁওতাল রাজ্য কায়েমের জন্য। সাঁওতাল আদিবাসীসহ মুক্তিকামী জনতার মধ্যে এই ঘোষণা সঞ্চালিত হলো। তারা মানসিকভাবে বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন।
আলোচনার জন্য ভগনাডিহ গ্রামে সাঁওতালরা সমবেত হলে সিদ্ধান্ত হয় পরদিন একসঙ্গে সবাই শিকারে বেরুবে। পরের দিন সিধু, কানুর নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন সাঁওতাল যুবক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শিকারে যাওয়ার পথে দারোগা মহেশ দত্ত, দুই জন সিপাই ও কয়েকজন মহাজনের সামনে পড়ে। দারোগার সঙ্গে দুইটি দড়ি বোঝাই গাড়িও ছিল। এক পর্যায়ে বিদ্রোহী সিধু, কানুর সশস্ত্র দল ঘটনাস্থলে দারোগা মহেশ এবং কানু মানিক রায় নামের মহাজনকে হত্যা করে। এ ঘটনার পর ভোগলপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
বিভিন্ন জায়গায় সরকারি-বেসরকারি লোকজনসহ অত্যাচারী জমিদার মহাজন অনেকে সাঁওতালদের হাতে নিহত হতে থাকে। ১৮৫৫ সালে ১৭ আগস্ট সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের আত্মসমপর্ণের আহ্বান জানানো হয়। বিদ্রোহীরা সরকারের আহ্বান ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। সরকার সেনাবাহিনী মাঠে নামায় এবং তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে শত শত বিদ্রোহীকে হত্যা শুরু করে। একদিকে কামান-বন্দুক, অপর দিকে তীর-ধনুকের লড়াই। কয়েক দিনের মধ্যেই সেনাবাহিনী ভগনাডিহ গ্রাম ধ্বংস করে দেয়।
সিধু, কানুর বাড়িসহ গ্রামের সকল বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। কানু সঙ্গীদের নিয়ে হাজারীবাগ অভিমুখে পালাবার সময় জারয়ার সিং নামক ব্যক্তির তৎপরতায় ১৮৫৫ সালের ৩০ নভেম্বরে ধরা পড়ে। শেষে কানুর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ, লুণ্ঠন, অত্যাচার ও হত্যার অভিযোগে ১৮৫৬ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি স্পেশাল কমিশনার এলিয়টের এজলাসে বিচার হয়। বিচারে কানুকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এই বিদ্রোহে ৩০ হাজার আদিবাসী প্রাণ হারান।
সাঁওতাল বিদ্রোহ ভারতের ইতিহাসের এক অগ্নিঝরা অধ্যায়। যে ধরনের শাসন, শোষণ এবং উৎপীড়ন থেকে পরাধীন জাতির চেতনায় স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে ১৮৫৫ সালে সংঘটিত এই বিদ্রোহ সেই অত্যাচারের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘটিত প্রতিবাদ। বিদ্রোহের এই আগুন সে সময় বিহার, উড়িষ্যা এবং বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
সাঁওতালদের পরাজয় হলেও, বৈদেশিক শাসন এবং দেশিও সামন্ত্রতান্ত্রিক শোষণের মূলোৎপাটন করার লক্ষ্যে পরিচালিত এই বিদ্রোহ ভারতবর্ষের মানুষের মনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আত্মনিয়ন্ত্রাধিকারের চেতনা জাগ্রত করেছিল।
এই বিদ্রোহের পিছনে ছিল একাধিক কারণে সমাবেশ। সেগুলি হল-
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ:
রাজস্বের চাপ: বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর, মানভূম, ছোটনাগপুর ও পালামৌ অঞ্চলের গভীর বনভূমিতে সাঁওতালরা বসবাস করত এবং কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে কৃষি কার্যের দ্বারা জীবিকা নির্ভর করত। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর ওই অঞ্চল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্বের অধীনে আসে। জমিদার ও কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচারে তারা ওই অঞ্চল ত্যাগ করে রাজমহল পার্বত্য অঞ্চল ও মুশিদাবাদের একাংশে বনভূমি পরিষ্কার করে বসবাস ও কৃষিকাজ শুরু করে। এই অঞ্চল দামিনী-ই-কোহ বা পাহাড়ের প্রান্তদেশ নামে পরিচিত। কিন্তু কিছুদিন পর সরকার ওই অঞ্চলেও জমিদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে সাঁওতালদের ওপর পুনরায় রাজস্বের চাপ বৃদ্ধি পায়। ফলে সাঁওতালরা ক্ষুব্ধ হয় ও বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।
মহাজনি শোষণ: নতুন জমিদারি ভুমি বন্দোবস্ত অনুযায়ী সাঁওতালদের নগদ অর্থে খাজনা মিটাতে হতো। রাজস্ব প্রদান ও খাদ্যাভাব মেটাতে তাদের মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হতো। সাঁওতালদের সরলতা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে মহাজনরা তাদের কাছ থেকে যথেচ্ছ হারে সুদ আদায় করত। একবার ঋণ নিলে ঋণের জাল থেকে বেরিয়ে আসা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হতো না। ঋণের দায়ে তাদের চাষের বলদ, জমির ফসল, জমি, পরিবার, এমনকি নিজেকেও হারাতে হত। তাই এই ঋণের জাল থেকে মুক্তির আশায় সাঁওতালরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
ব্যবসায়ীদের শোষণ: বিভিন্ন ব্যবসায়ীরাও সাওতালদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের কাছে বেশি দামি জিনিস বিক্রি করতো এবং কম দামে সাঁওতাল দের কাছ থেকে জমির ফসল কিনত। শুধু তাই নয় তারা কেনারাম ও বেচারাম নামক দু'ধরনের বাটখারা ব্যবহার করে সাঁওতালদের ওজনেও ঠকাতো। এই অন্যায়ের প্রতিকারের আশায় তারা বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।
নীলকরদের শোষণ: সাঁওতালদের ক্ষোভের আরেকটি কারণ ছিল নীলকরদের শোষন ও অত্যাচার। নীলকর সাহেবরা খাদ্যশস্যের পরিবর্তে সাঁওতালদের নীল চাষে বাধ্য করতো এবং নীলচাষ করতে অস্বীকার করলে সমগ্র সাঁওতাল পরিবারের উপর তারা শারীরিক নির্যাতন চালাতো। এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সাঁওতালরা বিদ্রোহে সামিল হয়েছিল।
সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচার: সরকারি কর্মচারী ও বিচার বিভাগ অন্যায় ভাবে জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। উপজাতি ভুক্ত সাঁওতালদের সভ্যতার লজ্জা মনে করে সরকারি কর্মচারীরা তাদের উপর অত্যাচার চালাত।এঅবস্থায় তারা কোম্পানির সরকারকেই রক্ষাকর্তা মনে করলেও সরকার তাদের অভাব অভিযোগের কোন প্রতিকার করেননি। তাই সার্বিক শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় তারা শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহের পথ বেছে নিয়েছিল।
রেল কর্মচারীদের অত্যাচার: লর্ড ডালহৌসি শাসনকালে রাজমহল, রামপুরহাট, ভাগলপুর, সাহেবগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে রেলপথ সম্প্রসারণ এর কাজ শুরু হলে ওই সমস্ত অঞ্চলে ইংরেজ রেলকর্মচারী ঠিকাদারদের আবির্ভাব ঘটে। এরা সাঁওতালদের নামমাত্র মজুরিতে শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ করত এবং জোর করে সাঁওতালদের হাঁস, মুরগি, ছাগল কেড়ে নিত। এমনকি সাঁওতাল মহিলাদের সঙ্গেও তারা অসভ্য আচরণ করত। এই সব ঘটনায় ক্ষুব্দ হয়ে সাঁওতালরা ভদ্রলোক বিরোধী বা দিকু বিরোধী আন্দোলন শুরু করে।
ধর্মীয় উন্মাদনা এবং সিধু-কানহুর নেতৃত্বদান: সাঁওতাল বিদ্রোহের পিছনে ধর্মীয় উন্মাদনাও কাজ করেছিল। খ্রিষ্টান মিশনারীরা জোর করে সাঁওতালদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করলে সাঁওতালরা ক্ষুব্দ হয়। এমতাবস্থায় ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে সাঁওতাল নেতা সিধু ও কানহু ঘোষণা করেন যে, 'ঈশ্বর তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে বিদ্রোহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই বিদ্রোহে তাদের জয় হবে। কারণ ঈশ্বর স্বয়ং তাদের হয়ে যুদ্ধ করবেন।' তারা প্রচার করেন, 'ঈশ্বরের দয়ায় ইংরেজদের বুলেট নিষ্ফল হবে, যারা যুদ্ধে নিহত হবে তারা ঠাকুরের দোয়ায় আবার জীবিত হয়ে উঠবে।' এইসব বক্তব্য প্রচার নিরক্ষর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাঁওতালদের মনে আশার সঞ্চার করে। অবশেষে ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে জুন সিধু ও কানহুর নেতৃত্বে প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে সমবেত হয়ে স্বাধীন সাঁওতাল পরগনা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা করে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের বিদ্রোহের প্রসার:
১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে জুন সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হলেও অচিরেই এই বিদ্রোহ ভাগলপুর, মুঙ্গের, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সাঁওতাল বিদ্রোহীদের সমর্থনে কামার, কুমোর, ছুতোর ও তাঁতিরাও এগিয়ে আসে এবং তাদের হাতে বহু জমিদার ও মহাজন নিহত হন। সিধু-কানহু ছাড়াও চাঁদ, ভৈরব, বীর সিং, কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমুখ এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিশাল সেনাবাহিনীর সাহায্যে এই বিদ্রোহ দমন করে। সিধু, কানহুসহ অন্যান্য সাঁওতাল নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয় এবং বহু সাঁওতাল বিদ্রোহীর ৭ থেকে ১৪ বছর কারাদণ্ড হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সৈন্যরা প্রায় ৩৬ টি সাঁওতাল গ্রাম ধ্বংস করে দেয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব ও ফলাফল:
সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই বিদ্রোহের পর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সাঁওতালদের সম্পর্কে কিছুটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে। সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন করা হয় এবং সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
- সাঁওতাল পরগনায় সুদের হার বেঁধে দেওয়া হয় এবং মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ইউরোপীয় মিশনারী ছাড়া অন্যান্য মিশনারীদের সাঁওতাল পরগনায় প্রবেশও নিষিদ্ধ করা হয়।
- সাঁওতালদের অভাব-অভিযোগের প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য সরকারি কর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস করা হয়নি বা সাঁওতালদের জমির অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াও হয়নি।
- সাঁওতাল বিদ্রোহের পর সাঁওতাল পরগনায় ইউরোপীয় মিশনারী ছাড়া অন্যান্য মিশনারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলে ইউরোপিয় খ্রিস্টান মিশনারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সাঁওতালদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে তাদের মনে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য বোধ সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে ওঠেন।
- সাঁওতাল বিদ্রোহ কৃষক কথা সাধারণ মানুষকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা যোগায়, যা পরবর্তীকালে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের মতে, "এই বিদ্রোহ সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূল পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিয়াছিলো এবং ইহা ছিল ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত স্বরূপ।
- অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল দরিদ্র জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজের মতে, 'এই বিদ্রোহ ছিল সকল সম্প্রদায়ের জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধ।' কারণ সাঁওতাল যুবকরা এই বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি হলেও কামার, কুমোর, ছুতোর ও তাঁতি সম্প্রদায় কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ, এমনকি নারীরাও এই বিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, যদি ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে মহাবিদ্রোহ কে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মনে করা হয়, তবে সাঁওতালদের এই সুকঠিন সংগ্রামকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত।
0 মন্তব্যসমূহ