আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা | আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য: (Difference between international relations and international politics).


সমাজবিজ্ঞান (Social Science) -পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।সমাজের অগ্রগতি সাধিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিকের মধ্যে জটিলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে দর্শন, ইতিহাস, অর্থবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রাজনৈতিক সমাজবিদ্যা প্রভৃতি শাস্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। এইসব শাস্ত্রের সমষ্টিকেই বলা হয় সমাজবিজ্ঞান বা সোশ্যাল সায়েন্স। আন্তর্জাতিক রাজনীতি তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রথমদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তা একটি পঠনপাঠন ও গবেষণাযোগ্য বিষয় হিসেবে, অর্থাৎ একটি পৃথক শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করে।

বিশেষত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ১৮২৩ সাল থেকে নিজেকে বিশ্বরাজনীতির অঙ্গন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ ক’রে একমাত্র আণবিক শক্তির অধিকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তা ছাড়া, ওই রাষ্ট্রটি তদানীন্তন বিশ্বের একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব - প্রতিপত্তি রোধ করার জন্য ‘ন্যাটো', ‘সেন্টো', ‘সিয়াটো' প্রভৃতি আঞ্চলিক শক্তিজোট গড়ে তুলেছিল। অন্যদিকে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সোভিয়েত ইউনিয়নও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পাদন করেছিল ‘ওয়ারশ চুক্তি'। এইভাবে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চ ক্ষমতার রাজনীতি -মঞ্চে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ঘানা প্রভৃতি রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ ওই দুটি শক্তিজোটে যোগদান না করে যে - আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’ নামে পরিচিত।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কেবল পূর্বোক্ত ‘রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের' নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করে না, সেই সঙ্গে অ-রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা যেমন, জাতিসংঘ, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, অর্থাৎ রাষ্ট্রসংঘ প্রভূতি অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়ে আলোচনা করে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন সংজ্ঞা:
বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি পৃথক শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করলেও তার কোনো সুনির্দিষ্ট ও সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে স্ট্যানলি হফম্যান বলেছেন যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সাম্প্রতিক সংজ্ঞাকে কেন্দ্র করে যথেষ্ট বিভ্রান্তি রয়েছে। তাই আলোচ্য বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এখনও সুষ্ঠু ও সুঠাম রূপ পরিগ্রহ করতে পারেনি। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা নির্ধারণের অন্যতম প্রধান সমস্যা হল — আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে অনেক সময় ‘বিশ্ব রাজনীতি’ ও ‘আন্তর্জাতিক রাজনীতি’ -র সমার্থক বলে মনে করা হয়।

  • হার্টম্যান -এর মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয়, যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে।
  • কুইনসি রাইট - এরূপ সংজ্ঞাকে সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট বলে মনে করেন। তাঁর মতে, ‘অনিশ্চিত সার্বভৌমিকতার অধিকারী সংগঠনগুলি' - কে নিয়ে যে - শাস্ত্র আলোচনা করে, তাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলে।
  • নিকোলাস স্পাইকম্যান -এর মতে  “বিভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্গত ব্যক্তিবর্গের সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনা করে” বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
  • হ্যান -একটি কার্যকরী ও কিছুটা সংকীর্ণতামুক্ত সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাঁর মতে, বিশ্ব যেসব মূল এককে বিভক্ত, তাদের বহির্বিষয়ক নীতি ও শক্তিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম উপাদানসমূহ ও কার্যাবলি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনা করে।
  • পামার ও পারকিনস্ বলেছেন, বিশ্বের সব মানুষ ও গোষ্ঠীর যাবতীয় সম্পর্ক, মনুষ্য - জীবন, তাদের কার্যকলাপ ও চিন্তার প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি , চাপ ও প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনা করে থাকে। তাঁরা রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বিষয়গুলিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
  • কে. জে. হলটি  - র মতে, সাধারণভাবে নিয়মিত প্রক্রিয়া অনুসারে পরস্পরের ওপর ক্রিয়াশীল স্বাধীন রাজনৈতিক শর্তাবলিকে নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনাকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলে।
  • জন হাউস্টন বলেছেন যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয়, যা আন্তর্জাতিক সম্মেলন, কূটনীতিবিদদের গমনাগমন, চুক্তি সম্পাদন, সৈন্যবাহিনী নিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অবাধ প্রসার - সহ বহু ও বিচিত্র বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর ভাবধারা ও মতাদর্শও এইসব বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা:
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয়, যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে অরাষ্ট্রীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংগঠন, ক্ষমতা, জাতীয় স্বার্থ, রাজনৈতিক মতাদর্শ, যুদ্ধ ও শান্তি, নিরস্ত্রীকরণ, জাতিসত্তা, কূটনীতি, স্বার্থগােষ্ঠী, জনমত, প্রচার, সন্ত্রাসবাদ, বিশ্ব বাণিজ্য, বিশ্ব পরিবেশ, বিশ্বায়ন প্রভৃতির মতাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলােচনা করে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য:
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে এমন একটি বিষয় কে বোঝায়, যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের বহুমুখী ও বিচিত্র বিষয় সহ সরকারি ও বেসরকারি এবং রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক যাবতীয় বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো প্রয়োগগত দিকও আলোচনা করে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি হলো এমন একটি বিষয়, যা রাজনৈতিক মতানৈক্য, প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বীতা, দাবি ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পরিবর্তনে আশঙ্কায় থেকে উদ্ভূত ফলাফল পর্যালোচনা করা।

অনেক সময় আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমার্থক বলে মনে করা হয়। হান্স মর্গ্যান তার বিখ্যাত গ্রন্থ পলিটিক্স অ্যামং নেশনস গ্রন্থে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ব্যবহার করার ফলে বিভ্রান্তি যথেষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু পামার পারকিন্স, হলস্টি, শ্লেইচার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন।

পরিধিগত পার্থক্য:
আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচনা ক্ষেত্রের পরিধি অপেক্ষা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা ক্ষেত্রের পরিধি অনেক বেশি ব্যাপক। হলস্টি এদের মধ্যে পরিধিগত পার্থক্য দেখাতে গিয়ে বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিদেশনীতি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও নীতিবোধ, আন্তর্জাতিক পর্যটন প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে, কিন্তু সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতি ও কর্মসূচির বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিচার বিশ্লেষণ। 

বিষয়বস্তুগত পার্থক্য:
বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক, আইন, অর্থনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সংগঠন, যুদ্ধ প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা, শত্রুতা ও মিত্রতার হতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিবেচ্য বিষয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি প্রধানত বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ ও সংঘর্ষ নিয়ে আলোচনা করো। সুতরাং বলা যায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য বিষয়বস্তুর যথেষ্ট ব্যাপক হলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তু সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ।

প্রকৃতিগত পার্থক্য:
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি শাস্ত্র যা সমাজবিজ্ঞানের একটি নবীন শাস্ত্র হিসেবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের বহুমুখী সরকারি - বেসরকারি রাজনৈতিক অরাজনৈতিক বিষয়ের তত্ত্বগত ও প্রয়োগযোগ্য দিক নিয়ে আলোচনা করে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এমন একটি ক্ষমতা যা প্রতিযোগিতা, মতানৈক্য, রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পরিবর্তন, বিবর্তন, পদ্ধতি এবং সমসাময়িকভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করে।

সুতরাং, বলা যায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু ব্যাপক হলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তু সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। তবে এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অংশ বলে বিবেচিত হলেও এই অংশটিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সর্বপ্রধান বা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে চিহ্নিত করা যায়।

0 মন্তব্যসমূহ