আধুনিক বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির উপনিবেশ প্রসারের কৌশল ‘নয়া উপনিবেশবাদ’ ও ‘নয়া সাম্রাজ্যবাদ' নামে পরিচিত। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে জে. এ. হবসন এবং ভি. আই. লেনিন সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ সম্পর্কে তাঁদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
হবসনের ব্যাখ্যা:
বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে. এ. হবসন তাঁর ‘Imperialism: A Study' গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও আদর্শগত কারণ হয়তো ছিল, তবে আসল কারণ হল অর্থনৈতিক। এই কারণগুলি হল-
উদ্বৃত্ত পুঁজির সৃষ্টি: ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতি মালিকদের হাতে বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর মুলধন সঞ্চিত হয়। ইউরোপের পুঁজিপতিরা এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজেদের দেশে শিল্পের প্রসার ঘটাত এবং উৎপাদিত শিল্পদ্রব্য অনুন্নত দেশগুলিতে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করত।
পুঁজিপতিদের চাপ: ‘বাড়তি মূলধনের চাপ'ই সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশ দখলের মূল কারণ। পুঁজিপতি শ্রেণি তাদের উদ্বৃত্ত মুলধন উপনিবেশে বিনিয়োগ করে আর মুনাফা অর পরিকল্পনা করে। এজন্য তারা নিজ নিজ দেশের সরকারকে চাপ দিয়ে উপনিবেশ দখলে বাধ্য করে।
অর্থনৈতিক শোষণ: পুঁজিপতি শ্রেণির অন্যতম লক্ষ্য ছিল অধিক মুনাফা ও সম্পদ অর্জন। এই লোভে তারা সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ, উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রির বাজার দখল প্রভৃতির জন্য ইউরোপের বাইরে এশিয়া ও আফ্রিকায় নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা নিজ দেশের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
ঔপনিবেশিকতা অবসানের উপায়: হবসন বলেন যে, সম্পদের সুষম বণ্টন ও অভ্যন্তরীণ সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে এর সমাধান হতে পারে। তিনি পুঁজিপতিদের বাড়তি মূলধন দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিতরণ এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যে তা ব্যবহারের কথা বলেন। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হলে তারা কলকারখানায় উৎপাদিত উদ্বৃত্ত শিল্পসামগ্রী কিনে ব্যবহার করতে পারবে। এর ফলে উদ্বৃত্ত পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য আর উপনিবেশ দখলের প্রয়োজন হবে না।
লেনিনের ব্যাখ্যা:
বিখ্যাত রুশ কমিউনিস্ট নেতা ভি. আই. লেনিন সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রসারে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর 'Imperialism: the Highest Stage of Capitalism' গ্রন্থে। সেগুলো হল-
পুঁজির উদ্ভব: শিল্পের অগ্রগতির ফলে ইউরোপের দেশগুলির যুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে বিপুল পরিমাণ পুঁজি সঞ্চিত হয়। এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী দেশগুলি ইউরোপের বাইরে নতুন উপনিবেশের প্রসার ঘটিয়ে সেখানে উদ্বৃত্ত পুঁজি বিনিয়োগের বিভিন্ন ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
বাজার দখল ও কাঁচামাল সংগ্রহ: লেনিনের মতে, পুঁজিবাদের জঠরে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম। বেশি মুনাফা লাভের আশায় দেশের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এই পণ্য বিক্রি এবং শিল্পোৎপাদনের জন্য সস্তায় কাচামাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পুঁজিবাদী গুলি উপনিবেশ দখলের চেষ্টা চালায়।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা: বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উপনিবেশ দখলের উদ্যোগ নিলেও উপনিবেশের সংখ্যা ছিল সীমিত। পরবর্তীকালে উপনিবেশ দখলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে কাড়াকাড়ি অর্থাৎ প্রতিযোগিতা হয়ে যায়। এই প্রতিযোগিতার পরিণতি হল যুদ্ধ। লেনিনের মতে, পুঁজিবাদী অর্থনীতি হল যুদ্ধের জন্মদাতা।
শ্রমিক শ্রেণির প্রতিষ্ঠা: ইউরোপের পুঁজিপতি শ্রেণি এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত অঞ্চলগুলিকে বেছে নিয়ে সেখানে পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং সেখানকার নতুন শ্রমিক শ্রেণির ওপর সীমাহীন শোষণ চালায়। এর পুঁজিপতিরা যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লাভ করে তার একটি ক্ষুদ্র অংশ নিজ দেশের শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে খরচ করে তাদের বশীভূত করে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের অনুগত একধরনের অভিজাত শ্রমিক শ্রেণি তৈরি করে।
0 মন্তব্যসমূহ