মহম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণের বিস্তারিত আলোচনা:


ভারতের মুসলমান আধিপত্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহম্মদ ঘোরী। আরবদের সিন্ধু আক্রমণের ফল ছিল শূন্য। মহম্মদ গজনীর কর্তৃত্ব সামান্য সময়ের জন্য কেবল পাঞ্জাব অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু মহম্মদ ঘোরী কার্যকারী ভাবেই ভারতের মুসলমান কর্তৃত্বে সূচনা করে যান।

ঘোররাজ্যের প্রতিষ্ঠা:
গজনী হিরাটের মধ্যবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে ঘোররাজ্য অবস্থিত ছিল। সাসাবনী বংশোদ্ভূত রাজাগণ এখানে শাসন পরিচালনা করতেন। আলাউদ্দিন খলজির সময় থেকেই ঘোররাজ্যের উত্থান শুরু হয়। একই সময়ে 'খিবা' অঞ্চলে খারিজম ছিল খুব শক্তিশালী রাজ্য। ঘোররাজ গিয়াসউদ্দিনের রাজত্বকালে তাঁর ভ্রাতা শিহাবউদ্দিন গজনী দখল করে নিজ শাসন শুরু করেন। শিহাবউদ্দিনই ইতিহাসে মহম্মদ ঘোরী নামে পরিচিত।

মহম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণ:
মহম্মদ ঘোরী ছিলেন কর্মক্ষম ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি। রাজ্যজয় ও সাম্রাজ্যবিস্তার করা ছিল তার অন্যতম নেশা। মধ্য এশিয়ার শক্তিশালী খারিজম রাজ্যের সাথে যুদ্ধের পরিবর্তে ভারতে রাজ্যজয়কেই তিনি সহজতর মনে করেন এবং ভারত আক্রমণ করেন। মহম্মদ ঘোরী প্রথম ভারত আক্রমণ করেন ১১৭৫ খ্রীষ্টাব্দে। ঐ বছর তিনি ‘মুলতান’ ও ‘সিন্ধু’ জয় করেন। তারপর তিনি ‘উচ্’ দুর্গ আক্রমণ করেন। কথিত আছে, উচের রাজপুত মহিষীর সাথে ষড়যন্ত্র করে ঘোরী এই দুর্গ দখল করতে সক্ষম হন। প্রায় দুই বছর পর তিনি গুজরাট আক্রমণ করেন (১১৭৮ খ্রীঃ)। কিন্তু সেখানকার রাজপুত রাজা ভীমদেও-র হাতে পরাজিত হয়ে ঘোরী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

মহম্মদ ঘোরীর পাঞ্জাব বিজয়:
১১৭৯ থেকে ১১৮৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ঘোরী লাহোর এবং পাঞ্জাবের গজনীবংশীয় শাসকদের পরাজিত করে ঐ অঞ্চল দখল করেন। পাঞ্জাব দখল করার পর ঘোরী মধ্য-ভারত বিজয়ে অগ্রসর হন। ভারতের ঐশ্বর্য এবং ভারতীয় রাজাদের অন্তর্কলহ ও তজ্জনিত দুর্বলতার কথা ঘোরীর অজানা ছিল না। তাই ধন সম্পদ লাভ ও রাজ্যবিস্তার — এই দুই উদ্দেশ্য নিয়ে ঘোরী আক্রমণ রচনা করেন।

তরাইনের প্রথম যুদ্ধ (১১৯১):
১১৯১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি দিল্লী ও আজমীরের চৌহান - বংশীয় রাজা পৃথ্বীরাজের পাঞ্জাব বিজয় বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। 'ফেরিস্তার বিবরণ' থেকে ঘোরী - চৌহান সংঘর্ষের কাহিনী জানা যায়। এই যুদ্ধে একমাত্র কনৌজরাজ জয়টাদ ব্যতীত সমস্ত রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজের পক্ষে যোগদান করেন। প্রথম আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে ঘোরী ‘ভাতিন্দা’ নামক স্থান দখল করে নেন। অতঃপর পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বে মিলিত রাজপুত বাহিনীর সাথে তরাইনের প্রান্তরে ঘোরীর যুদ্ধ হয়। রাজপুতদের আক্রমণে ঘোরীর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়৷ গুরুতর আহত অবস্থায় কোনক্রমে ঘোরী গজনীতে প্রত্যাবর্তন করেন।

তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ (১১৯২):
মহম্মদ ঘোরী নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করে ঘোরী পরের বছরেই পুনরায় তরাইনের প্রান্তরে উপস্থিত হন (১১৯২ খ্রীঃ)। এবারেও কনৌজ ব্যতীত অন্যান্য রাজপুত রাজারা পৃথ্বীরাজের সাথে মিলিতভাবে মহম্মদ ঘোরীকে বাধা দেন। কিন্তু সুশৃঙ্খল ও সুগঠিত তুর্কী - অশ্বারোহী বাহিনীর কাছে রাজপুত বাহিনী পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধ ‘তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ' নামে খ্যাত। এখানে জয়ী হবার পর তুর্কীবাহিনী হালী, সমান, খুরাম প্রভৃতি দুর্গ দখল করে। তারপর আজমীর নগরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু জয়লাভ করা সত্ত্বেও বাৎসরিক করদানের শর্তে আজমীর পৃথ্বীরাজের এক পুত্রের শাসনাধীনে রাখা হয়। অতঃপর কুতুবৃউদ্দিন নামক জনৈক বিশ্বস্ত অনুচরের হাতে ভারতীয় সাম্রাজ্যের শাসন - দায়িত্ব অর্পণ করে ঘোরী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

মহম্মদ ঘোরীর বাংলা বিজয়:
কুতুবৃউদ্দিনের নেতৃত্বে মীরাট, দিল্লী, রণথম্ভোর প্রভৃতি স্থানে তুর্কী অধিকার বিস্তৃত হয়। ১১৯৪-৯৫ খ্রীষ্টাব্দে পুনরায় ভারতে এসে ঘোরী কনৌজরাজ জয়চাঁদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। এই যুদ্ধে জয়চাঁদের পরাজিত ও নিহত হলে দোয়াব অঞ্চলে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সময়ে ইতিয়ারউদ্দিন-মহম্মদ-বিন-বখতিয়ার খলজী নামক জনৈক ভাগ্যান্বেষী তুর্কী - সৈনিক পূর্ব - ভারতে মুসলমান - কর্তৃত্ব বিস্তৃত করেন। তিনি প্রথমে বিহার দখল করেন (১১৯৭ খ্রীঃ)। ঐ সময়ে তিনি বাংলার ঐশ্বর্যের সংবাদ পান। তারপরে সসৈন্যে নদীয়াতে উপস্থিত হন। তৎকালীন বাংলার রাজা সেনবংশীয় লক্ষ্মণ সেন তুর্কীদের আকস্মিক আক্রমণে বিভ্রান্ত হয়ে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন। বখতিয়ার বিনা বাধায় নদীয়া দখল করেন।

মহম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণের ফলাফল:
ভারতে মহম্মদ ঘোরী ও তার অনুগামীদের আক্রমণ ও জয়লাভ এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে।

রাষ্ট্রীয় ঐক্য: ঘোরীই প্রথম এদেশে স্থায়ী মুসলমান শাসনের সূচনা করেন। ফলে এদেশে সুদীর্ঘকালের হিন্দু-শাসনের ক্রম-অবসান ঘটে। একইভাবে ফিরে আসে ভারতের রাষ্ট্রীয় ঐক্য। মুসলমান শাসকদের আক্রমণে এদেশের ছোট-বড় বহু আঞ্চলিক রাষ্ট্রীয় ঐক্য রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পরিবর্তে গড়ে ওঠে কেন্দ্রীয় বৃহৎ রাজ্য। তা ছাড়া মুসলমান শাসনে সারাদেশের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটার ফলে ভারতের প্রশাসনিক ঐক্য সুদৃঢ় হয়।

বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ: তুর্কী শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বহির্বিশ্বের সাথে ভারতের যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। স্যার যদুনাথ সরকারের ভাষায়, 'বৈদিক যুগে বৃহত্তর এশিয়ার সাথে ভারতের যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল, পরবর্তী যুগে নতুন হিন্দুসমাজের পুনর্গঠনের ফলে তার অবনতি ঘটেছিল। ফলে ভারত নিজ প্রাকৃতিক বেষ্টনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তুর্কীদের আক্রমণ ও তাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বহির্বিশ্বের সাথে পুনরায় ভারতের যোগাযোগ স্থাপিত হয়।'

জাতিভেদের অবসান: নাগরিক জীবনের সুখ-সুবিধার ক্ষেত্রে তুর্কী-শাসন জাতিগত ও বর্ণগত রৈষম্যের অবসান ঘটায়। রাজকার্যে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে উচ্চ-নীচ সব শ্রেণীর মানুষের সম-অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। একই ভাবে সেনাবাহিনীতেও সব শ্রেণীর মানুষ অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে।

নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব: হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে ইসলাম সংস্কৃতির মিলনে ভারতের শিল্প, স্থাপত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। প্রাথমিক দ্বন্দ্ব ও নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব বিরূপতা সত্ত্বেও কালক্রমে উভয় সংস্কৃতির যুগলবন্ধনে ভারতীয় সংস্কৃতি নবতর মর্যাদার ভূষিত হয়েছিল। এইভাবে ঘোরী প্রতিষ্ঠিত তুর্কী শাসন ভবিষ্যৎ ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছিল।

0 মন্তব্যসমূহ