রোমান সাম্রাজ্য এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা:


বিশ্বের ইতিহাসে রোমান সাম্রাজ্য এবং গুপ্ত সাম্রাজ্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দুটি সাম্রাজ্যের মধ্যে যেমন একাধিক সাদৃশ্য রয়েছে, তেমনি বৈশাদৃশ্যও বর্তমান। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই দুটি সাম্রাজ্যের অবদান অতুলনীয়।


রোমান সাম্রাজ্য এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের মধ্যে সাদৃশ্য:
সাম্রাজ্যবিস্তার নীতি: রোমান সম্রাটরা প্রথম থেকেই সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতি মনোযোগ দিয়েছিলেন। একারণেই তাদের সাম্রাজ্যের আয়তন ইটালি ছাড়িয়ে ইউরোপের অনেকাংশ, এশিয়া ও আফ্রিকার কিয়দংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
অন্যদিকে, গুপ্ত শাসকরাও সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতি মনোনিবেশ করেন। তাঁরা মগধের পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি দখল করতে শুরু করে। সমুদ্রগুপ্ত সমগ্র উত্তর ভারতের নয় জন রাজাকে পরাজিত করেন এবং দক্ষিন ভারতেও অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।

সমাজব্যবস্থা: রোমের সমাজব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল শ্রেণিবিভাজন। সমাজে তিনটি শ্রেণির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এগুলি হল- প্লেবিয়ান, প্যাট্রিসিয়ান এবং ক্রিতদাস।
অন্যদিকে, গুপ্ত যুগের সমাজে শ্রেণিবৈশম্য লক্ষ্য করা যায়। সমাজে চারটি শ্রেণির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এগুলি হল- ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। তবে এ যুগে নারীর মর্যাদাও অনেকাংশে ক্ষুন্ন হয়েছিল।

সাহিত্যচর্চা: শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চায় রোমানরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। তাঁরা লাতিন ভাষায় একাধিক সাহিত্য রচনা করতে শুরু করেন। ভার্জিল, টেসিয়াস, লিভি, হোরেস প্রমুখের রচনাগুলি সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত। সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের 'Meditation' আজও সমাদৃত হয়ে আছে।
অন্যদিকে, গুপ্ত শাসকরাও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। এ যুগে মহাকবি কালিদাস, বিশাখদত্ত, হরিষেণ প্রমুখ অসাধারন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।

ধর্মীয় জীবন: রোমান অধিবাসীরা ধর্মমতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরা একাধিক দেব-দেবীর আরাধনা করতেন। তাঁরা মূলত 'পেগান' ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। পরবর্তীকালে খ্রীস্টান ধর্ম জনপ্রিয় হওয়ায় তাঁরা খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত হন।
অন্যদিকে, গুপ্ত যুগে হিন্দু ধর্মের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রচলিত ছিল। ঐতিহাসিকরা গুপ্ত যুগকে 'হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের যুগ' বলে অভিহিত করেছেন।

রোমান সাম্রাজ্য এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের মধ্যে বৈসাদৃশ্য:
সাম্রাজ্যের বিস্তার ও পরিধি: রোমান সম্রাটরা (জুলিয়াস সিজার, অক্টাভিয়ান প্রথম থেকেই সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতি মনোনিবেশ করায় তাদের সাম্রাজ্য ইটালি ছাড়িয়ে ইউরোপেরর অনেকাংশে এবং এশিয়া ও আফ্রিকার কিয়দংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
অন্যদিকে, শক্তিশালি গুপ্ত সম্রাটরা (চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত) রাজ্যবিস্তারে মনোনিবেশ করলেও তা শুধুমাত্র ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের মতো সুবিশাল সাম্রাজ্য তাঁরা গড়ে তুলতে পারেন নি।

শাসন পরিকাঠামো: রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রজাতন্ত্র বা অভিজাততান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছিল।
অন্যদিকে, গুপ্ত রাজারা প্রথম থেকেই বংশানুক্রমিকভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। শাসনকার্যে সুবিধার জন্য উপরিক, মহাদন্ডনায়ক, মহাশ্বপতি প্রভৃতি পদের অস্তিত্ব থাকলেও শাসন পরিকাঠামোর সর্বোচ্চে আসীন ছিলেন রাজা নিজেই।

স্থায়িত্বকাল: দীর্ঘস্থায়ী রোমান সাম্রাজ্য ৭৫৩ খ্রীস্টপূর্বাব্দে শুরু হয়ে ৪৭৬ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ বছর স্থায়ী ছিল।
অন্যদিকে, গুপ্ত সাম্রাজ্য ২৭৫ খ্রীস্টাব্দে শুরু হয়ে ৫০০ খ্রীস্টাব্দ মতান্তরে ৫৫০ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল, যা রোমান সাম্রাজ্যের তুলনায় খুবই নগণ্য।

দাসপ্রথা: দাস প্রথার উপর ভিত্তি করেই রোমান সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। কৃষি, শিল্প, উৎপাদন সর্বক্ষেত্রেই দাসদের অবদান লক্ষ্য করা যায়।
অন্যদিকে, গুপ্ত যুগে দাসপ্রথার অস্তিত্ব খুবই কম, কঠোরতা বর্জিত ছিল। অর্থনীতি কখনই দাসদের উপর নির্ভরশীল ছিল না।

0 মন্তব্যসমূহ