৪ঠা মে আন্দোলনের কারণ, ফলাফল ও গুরুত্ব:


১৯১১ খ্রিস্টাব্দে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে চীনে একটি প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সরকারের বিভিন্ন কাজকর্মে চীনের সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এর ফলে দেশজুড়ে অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এছাড়া ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপান চীনে আগ্রাসন চালায়। যুদ্ধে চীন মিত্রপক্ষে যোগ দিলেও যুদ্ধের পর সে কোন সুবিচার পায়নি। এই পরিস্থিতিতে চিনে বিদেশিদের আধিপত্য অবসানের লক্ষ্যে চীনের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা ১৯১৯ খ্রীঃ ৪ঠা মে এক আন্দোলন শুরু করেন, যা ইতিহাসে ৪ঠা মে আন্দোলন নামে পরিচিত।


৪ঠা মে আন্দোলনের কারণ:
ইউয়ান-সি-কাই এর নৃশংসতা:
চিনের ইউয়ান-সি-কাই চিনে সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। সমস্ত সাংবিধানিক পদ্ধতি বাতিল করে তিনি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলির কাছ থেকে অপমানজনক শর্তে ঋণ নেওয়ার জন্য কথাবার্তা শুরু করেন। যারা এর বিরোধিতা করেন তাদের হত্যা করা হয়।

কুয়োমিতাং দল নিষিদ্ধ:
সান-ইয়াৎ-সেন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ইউয়ান-এর বিরুদ্ধে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব'-এর ডাক দেন। কিন্তু ইউয়ানের বাহিনী বিপ্লবীদের দমন করতে সক্ষম হয় এবং কুয়োমিনতাং দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এর ফলে চিনা জনগণের মনে হতাশার সৃষ্টি হয়।

জাপানের একুশ দফা দাবি:
সমগ্র চিনকে নিজেদের উপনিবেশে পরিণত করার উদ্দেশ্যে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জাপান চিনের কাছে ‘একুশ দফা দাবি' পেশ করে।

বিদেশি পণ্যের বাজার:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর চিনের অভ্যন্তরে জাপান-সহ অন্যান্য পুঁজিপতি দেশগুলি বাজার দখলের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে। ফলে চিনে নতুন গড়ে ওঠা শিল্পগুলি তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে এবং অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যায়।

প্রত্যক্ষ কারণ:
বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চিনে আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে শান্তি সম্মেলনে চিনের আবেদনে কেউ কর্ণপাত করেনি। এই অবস্থায় চিনের প্রতিনিধিরা শূন্য হাতে দেশে ফিরে আসেন।

আন্দোলনের সূত্রপাত:
বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চিনের সর্বত্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এই পরিস্থিতিতে চিনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চেন-ডু-শিউর ডাকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হাজার হাজার ছাত্র ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে পিকিং-এর 'তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ার'-এ সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই ৪ মে-র আন্দোলন ক্রমে চিনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাদের জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল 'জিউগুয়ো' অর্থাৎ দেশ বাঁচাও। চিনের প্রজাতন্ত্রী সরকার প্রথমে দমননীতির দ্বারা আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ছাত্র আন্দোলন দাবানলের মতো চিনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

৪ঠা মে-র আন্দোলনের গুরুত্ব:
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে চিনে যে সাংস্কৃতিক নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল তারই ফলশ্রুতি ছিল ৪ঠা মে-র আন্দোলন। ৪ঠা মে-র আন্দোলন ছিল চিনের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। এই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

দেশাত্মবোধ ও আধুনিকতার উদ্ভব:
৪ঠা মে আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই চিনে আধুনিকতা, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের সূচনা হয়।

সরকারের নতি স্বীকার:
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চাপে চিন সরকার নতি স্বীকারে বাধ্য হয়। আন্দোলনের চাপে সরকার বাধ্য হয়ে ধৃত ছাত্রদের ছেড়ে দেয় ও ভার্সাই সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করবে না বলে ঘোষণা করে।

কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা:
এই আন্দোলনের ফলেই চিনে কুয়োমিনতাং দলের পুনর্গঠন হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ঘটে।

সাংস্কৃতিক অগ্রগতি:
এই সময় চিনে বহু বইপত্র ও পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হলে সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ঘটে। চিনে নতুন সংস্কৃতিকে সবাই স্বাগত জানায়।

৪ঠা মে আন্দোলনের ফলাফল:
মৌলিক পরিবর্তন:
এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চিনা জন মানুষের দেশ প্রেম তথা জাতীয়তা বোধ জাগ্রত হয় এবং চীনে আধুনিকতার পথ তৈরি হয়।

সাম্যবাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি:
৪ঠা মে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চীনের সাম্যবাদ জনপ্ৰিয় হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে চীনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ:
চীনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীন তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ফেলতে সমর্থ হয়। যার ফলে চীনে আন্তর্জাতিক মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

অন্যান্য প্রভাব:
এই আন্দোলনের পর চীনের সাহিত্য সংস্কৃতি এক নতুন ধারার বইতে শুরু করে। চীনে একটি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মঞ্চ গড়ে ওঠে। এতে যোগ দেয় চিনা ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক কৃষক সকলেই।

উপসংহার:
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় ৪ঠা মে আন্দোলনের মধ্যে চীনের জাতীয় ও শ্রেণি স্বার্থের প্রতিফলন ঘটেছিল। ঐতিহাসিক জেসানোর মতে 'This combined expression of national and class interest was a silent future of the may 4th movement'.

0 মন্তব্যসমূহ