হিরোশিমা আর নাগাসাকির ইতিহাস মানব ইতিহাসের কলঙ্ক। এত নৃশংস, এত ঘৃণ্য আক্রমণ এর আগে কখনো পৃথিবী দেখেনি। এক মুহূর্তে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু। অসংখ্য মানুষকে তিল তিল করে অনিবার্য মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া, জনপদের পর জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। হতচকিত হয়ে পড়ে বিশ্বের মানুষ। শুধু কি তাই? তেজস্ক্রিয়তার অভিশাপ থেকে যায় ভবিষ্যৎ প্রজম্মের জন্য। সেদিন এই ভয়ঙ্কর বর্বরতার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না বিশ্বের মানুষ। একসঙ্গে লাখ লাখ মানুষের এভাবে মৃত্যু ছিল অকল্পনীয়। এই অচিন্তনীয় ধ্বংস দেখে সেদিন বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিল বিশ্ব। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে কত ভয়ঙ্কর, কতটা মানবঘাতী হতে পারে, তা প্রত্যক্ষ করেছে মানুষ।
হিরোশিমার ঘটনা:
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট ঘড়িতে তখন সকাল ৮টা বেজে ১৫ মিনিট। আমেরিকা থেকে উড়ে জাপানের হিরোশিমা শহরে এলো বি-২৯ সুপারফোর্টেস নামের একটি বিমান। বিমানের মধ্যে ছিল খুবই শক্তিশালী একটি বোমা।
বোমাটির নাম লিটল বয় (little boy)। এটি ছিল একটি আণবিক বা অ্যাটম বোমা। হঠাৎ লিটল বয় হিরোশিমার আকাশে বিস্ফোরিত হলো। মুহূর্তেই গোটা শহরজুড়ে তৈরি হলো নীল, সাদা রঙের আলো। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুতে আগুন ধরে গেল। বিস্ফোরণের দেড় কিলোমিটারের মধ্যে যা যা ছিল সব পুড়ে কয়লা হয়ে গেল। হাজার হাজার মানুষ পুড়ে মিশে গেল মাটির সঙ্গে।
যারা কিছুটা দূরে ছিল তাদের কষ্ট ছিল আরো বেশি। কারণ কারো শরীরের মাংস উঠে গেল। কারো হাত পা উড়ে গেল। কারো চোখ অন্ধ হয়ে গেল। বোমার আগুনের তাপে মানুষের শরীর জলশূন্য হয়ে গেল। ৪৮ হাজার বড় বড় বাড়ি পুড়ে কয়লা হয়ে গেল। মাটির নিচের আলু পর্যন্ত পুড়ে সিদ্ধ হয়ে গেল। হিচিয়ামা নামক নদীর জল হয়ে গেল গরম। এমনই ভয়াবহ ছিল সেই অ্যাটম বোমা।
এই বোমার আঘাতে মারা গিয়েছিল প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। আর আহত ২ লাখ মানুষ চিরদিনের জন্য হয়ে গিয়েছিল পঙ্গু।
লিটল বয়ের সম্পর্কে কিছু কথা:
- লিটল বয়ের তেজস্ক্রিয় পরমাণু: ইউরেনিয়াম-২৩৫.
- লিটল বয়ের ওজন: ৪০০০ কেজি।
- লিটল বয়ের দৈর্ঘ্য: ৯.৮৪ ফুট।
- লিটল বয়ের পরিধি: ২৮ ইঞ্চি।
- বহনকারী বিমানের নাম: বি-২৯ সুপারফোর্টেস।
- পাইলটের নাম: কর্নেল পল টিবেটস।
- বোমা পতনে সময় লাগে: ৫৭ সেকেন্ড।
- মূল আঘাত: শিমা সার্জিক্যাল ক্লিনিক।
- বিস্ফোরণের মাত্রা: ১৩ কিলোটন টিএনটির সমতুল্য।
হিরোশিমা শহর সম্পর্কে কিছু কথা:
হিরোশিমা শহরটির আয়তন ২৫৩ বর্গমাইল বা ৬৫৬ বর্গকিলোমিটার। ওসাকা থেকে এটি ১৭৫ মাইল বা ২৮০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এর দক্ষিণ-পূর্বদিকে রয়েছে জাপানের অন্যতম সুন্দর প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় কুরে। বোমায় বিধ্বস্ত হিরোশিমাকে ১৯৫০ সাল থেকে আবার নতুন করে গড়ে তোলা হয়। হিরোশিমা এখন জাপানের অন্যতম প্রধান শিল্পকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। শুধু তাই নয়, যেস্থানে লিটল বয় বিস্ফোরিত হয়েছিল সেখানে নির্মিত হয়েছে পিস মেমোরিয়াল পার্ক। ১৯৫৫ সাল থেকে এখানে পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী একটি বার্ষিক বিশ্বসম্মেলন নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
নাগাসাকির ঘটনা:
১৯৪৫ সালে ৯ আগস্ট তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ট্রুমান। তিনি শুধু হিরোশিমা শহর ধ্বংস করে খুশি হলেন না। জাপানের আরেকটি শহর নাগাসাকি শহরও তিনি ধ্বংস করতে চাইলেন। ট্রুমানের নির্দেশেই মাত্র ২ দিন পর অর্থাৎ ৯ আগস্ট বি-২৯ বক্সকার নামের একটি জঙ্গি বিমান নাগাসাকিতে উড়ে এলো। ওই বিমানে ফ্যাটম্যান (fat man) নামে শক্তিশালী একটি বোমা ছিল। ফ্যাটম্যানের ধ্বংস ক্ষমতা ছিল লিটল বয়ের চেয়ে কিছুটা কম। ওই দিন বেলা ১২টা ২ মিনিটে ফ্যাটম্যান নাগাসাকির আকাশে বিস্ফোরিত হলো।
শহরের ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল প্রায় ৭৪ হাজার মানুষ। পরের সব ঘটনা হিরোশিমা শহরের মতোই ভয়াবহ এবং কষ্টের। ওই দিন মিৎসুবিশি জাহাজ নির্মাণঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে। কিন্তু বোমাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং এর আঘাতে নাগাসাকির প্রায় অর্ধেক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
ফ্যাট ম্যানের সম্পর্কে কিছু কথা:
- ফ্যাট ম্যানের তেজস্ক্রিয় পরমাণু: প্লুটোনিয়াম-২৩৯.
- ফ্যাট ম্যানের ওজন: ৪৬৩০ কেজি।
- ফ্যাট ম্যানের দৈর্ঘ্য: ১০.৬ ফুট।
- ফ্যাট ম্যানের পরিধি: ৩৬ ইঞ্চি।
- বহনকারী বিমানের নাম: বি-২৯ বক্সকার।
- পাইলটের নাম: মেজর চার্লস ডব্লু সুইনি।
- বোমা পতনে সময় লাগে: ৪৩ সেকেন্ড।
- মূল আঘাত: মিৎসুবিশি স্টিল ও অস্ত্র কারখানা এবং মিৎসুবিশি-উরাকামি সমরাস্ত্র কারখানার মাঝে।
- বিস্ফোরণের মাত্রা: ২১ কিলোটন টিএনটির সমতুল্য।
নাগাসাকি শহরের সম্পর্কে কিছু কথা:
শহরটি জাপানের রাজধানী টোকিও শহর থেকে ৯৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পূর্ব চীন সাগরের তীরে কিউশুর পশ্চিম সৈকতে এই নগরী অবস্থিত। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নিহতদের স্মরণে সেখানে একটি শান্তি উদ্যান নির্মিত হয়েছে।
এই দুই বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে পরবর্তীতে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মারা যান আরো ২ লাখ ১৪ হাজার মানুষ। আর বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগসমূহের ওপর হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী হিরোশিমায় ২ লাখ ৩৭ হাজার এবং নাগাসাকিতে ১ লাখ ৩৫ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুবরণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন সাধারণ মানুষ।
এজন্য আমরা কখনোই যুদ্ধ চাই না। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন মৃত্যুর শহর দেখতে চাই না। এমন ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ দেখতে চাই না। পৃথিবীর দেশে দেশে এখনো যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ মানেই মৃত্যু। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস আর কষ্ট। একারণে আমাদের সবাইকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। আমরা যুদ্ধ চাই না। আমরা চাই শান্তি।
0 মন্তব্যসমূহ