ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্তিম লগ্নে যেসব ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সালের নৌ-বিদ্রোহ তাদের মধ্যে অন্যতম। আজাদ হিন্দ বাহিনীর দৃষ্টান্ত ইতিমধ্যেই ব্রিটিশ সরকারের ভারতীয় সেনাদের মনে ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তারা। তার ওপর ব্রিটিশ ও ভারতীয় নৌসেনাদের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ, ভারতীয় নৌ-সেনাদের স্বল্প বেতন প্রদান, ভারতীয় নৌ-সেনাদের নিম্নমানের খাদ্যবস্তু সরবরাহ করা এবং শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবিদ্বেষী নীতি ইত্যাদির জন্য ভারতীয় নৌসেনারা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি 'রয়াল ইন্ডিয়ান নেভি'র প্রধান এম.এস. খানের নেতৃত্বে বোম্বের তলোয়ার নামক যুদ্ধ জাহাজের ভারতীয় নাবিকগণ তাঁদের উচ্চমানের আহার্য সরবরাহ করা, পর্যাপ্ত বেতন প্রদান করা এবং ভারতীয় জাতীয় চরিত্র সম্পর্কে নৌ-সেনাধ্যক্ষের অসম্মানজনক উক্তির প্রতিবাদ ইত্যাদির জন্য প্রথম বিদ্রোহ শুরু করেন। এই উপলক্ষে বোম্বাই শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। ক্রমে সেই বিক্ষোভ বোম্বাই উপকূলস্থ অন্যান্য জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহীগণ রাজকীয় নৌবাহিনীর ব্রিটিশ পতাকা 'ইউনিয়ন জ্যাক' নামিয়ে দিয়ে ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করেন। জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লিগ ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থকরা নিজ নিজ পতাকা উত্তোলন করেন। ক্রমে ক্রমে কলকাতা, মাদ্রাজ, করাচি বন্দরেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বোম্বাই ও করাচি বন্দরে নৌ-বিদ্রোহ সর্বাপেক্ষা প্রবল আকার ধারণ করে। নৌ-বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় স্থলবাহিনীকে নিয়োগ করেন। ভারতীয় স্থলবাহিনী সহভারতীয় যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে অস্বীকার করেন। তখন ব্রিটিশ সৈন্যগণ ভারতীয় সেনাদের দমনে এগিয়ে আসেন। উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। বিদ্রোহীরা একের পর এক যুদ্ধ জাহাজ দখল করে সেখান থেকে ব্রিটিশ নৌসেনাদের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। সরকারি কর্মী, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ও সাধারণ জনগণ বিদ্রোহীদের সমর্থনে এগিয়ে আসায় বিদ্রোহ আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে নৌ-সেনাধ্যক্ষ গডফ্রে এক বেতার বার্তায় নাবিকদের আত্মসমর্পন করতে নির্দেশ দেন এবং বিদ্রোহ দমনে উপযুক্ত আগ্নেয়াস্ত্র এবং যুদ্ধ বিমান সংগ্রহের চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত সর্দার বল্লভভাই পটেলের চেষ্টায় বিদ্রোহ প্রশমিত হয়।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নৌ বিদ্রোহের কারণ: [Cause of Revolt of the Royal Indian Navy -1946]:
বেতন বৈষম্য: ইউরোপীয় নাবিকদের থেকে ভারতীয় নাবিকদের চেয়ে কম বেতন দেওয়া হত।
খাদ্য সরবরাহে বৈষম্য: ইউরোপীয় নাবিকরা উৎকৃষ্ট মনের খাবার পেলেও ভারতীয় নাবিকদের জন্য নিকৃষ্টমনের খাবার সরবরাহ করা হত।
জাতি বৈষম্য: জাতিবিদ্বেষের কারণে ইংরেজ নৌঅফিসার ও নাবিকরা ভারতীয় নাবিকদের ঘৃণা করতেন।
বৈষম্যমূলক আচরণ: বিপজ্জনক কেন্দ্রে যেখানে মৃত্যুর ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত বেশি সেখানে বেছে বেছে ভারতীয় নাবিকদেরই পাঠানো হত।
আজাদ হিন্দ ফৌজের সমর্থন: দিল্লির লাল কেল্লায় বিচারের সময় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারাধীন সমস্ত সেনাকে মুক্তি দিতে ভারতীয় নৌ সেনারা আন্দোলনের পথে অগ্রসর হন।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নৌ বিদ্রোহের গুরুত্ব: [Importance of Revolt of the Royal Indian Navy -1946]:
আপাত দৃষ্টিতে নৌ-বিদ্রোহ ব্যর্থ মনে হলেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই আন্দোলনের সূদুর প্রসারী গুরুত্ব ছিল, যেমন-
- নৌ-বিদ্রোহ চলাকালে বিদ্রোহীদের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়া যায়।
- প্রথমবারের জন্য সৈনিক ও সাধারণ মানুষের রক্ত রাজপথে প্রবাহিত হয়।
- নৌ-বিদ্রোহের ফলে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীতে অসন্তোষ প্রকট হয়।
- নৌ-বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের এই উপলবদ্ধি হয় যে সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যে তাদের পক্ষে ভারতে তাদের সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব আর বেশি দিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
এইভাবে নৌ-বিদ্রোহ ভারতকে স্বাধীনতা লাভের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
0 মন্তব্যসমূহ