রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বিবর্তনবাদ বা ঐতিহাসিক মতবাদ

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতবাদ হল বিবর্তনবাদ বা ঐতিহাসিক মতবাদ। অধ্যাপক গার্নারের মতে, রাষ্ট্র ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্টি হয়নি, রাষ্ট্র পশুশক্তির ফল নয়, চুক্তির দ্বারাও রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়নি, আবার পরিবারের সম্প্রসারণের কারণেও রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। বস্তুত, রাষ্ট্রের উৎপত্তির কোনো সরল সূত্র নেই। বিবর্তনবাদ অনুসারে, মানবসমাজের নানান জটিল উপাদানের মিশ্রণে বিবর্তনের পথে নিরবচ্ছিন্ন ক্রমবিকাশের ফলে আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে।


মানবসমাজের নিরবচ্ছিন্ন ক্রমবিকাশের পর্যায়ে রাষ্ট্র গঠনে যেসব উপাদানের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলি হল—

রক্তের সম্পর্ক: রক্তের সম্পর্ক রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক উপাদান। এই রক্তের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে পরিবার। মানুষের প্রাচীনতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান হল পরিবার। মানব জীবনের জৈব আকাঙ্ক্ষা এবং নারী ও শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের তাগিদ থেকে পরিবারটির জন্ম হয়।

ধৰ্ম: ধর্ম, একটি শক্তিশালী উপাদান, সমাজে জাদুকর হিসেবে কাজ করে। ধর্মের ভিত্তিতে পুরোহিত শ্রেণী তৈরি হয়েছিল। ধর্মের মাধ্যমে সমাজের আদেশ-নির্দেশ পালন করা হয়। ধর্মের প্রভাবে সমাজে সামাজিক অভ্যাস গড়ে ওঠে। ভূতপূর্ব মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রোউইলসন বলেছিলেন – “রক্তের সম্পর্ক ছিল প্রতীক ও চিহ্ন ছিল ধর্ম ছিল ঐক্য, পবিত্রতা ও আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ।

যুদ্ধবিগ্রহ: রাষ্ট্রের বিবর্তনে যুদ্ধবিরতির অবদানকে উপেক্ষা করা যায় না। প্রাচীনকালে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল। দুর্বল শ্রেণীকে বাঁচাতে একজন শক্তিশালী দলনেতার প্রয়োজন ছিল। এভাবেই সময়ের সাথে রাজকীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটে। এছাড়াও, আধুনিক ইতিহাসে রাষ্ট্রে রাষ্ট্র যুদ্ধের ফলে নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভবের ঘটনা রয়েছে।

অর্থনৈতিক চেতনা: সমাজবিকাশের একটি স্তরে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার প্রচলন হয়। এই সম্পত্তিকে সুরক্ষিত করার জন্য মালিকশ্রেণি এক ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আশ্রয় নেয়। এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের জন্ম হয় রাষ্ট্রের বিবর্তনে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ব্যবস্থার ভূমিকাকে উপেক্ষা করা যায় না। যাঁরা মার্কসবাদে বিশ্বাসী তাঁরা এই উপাদানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

রাষ্ট্রনৈতিক চেতনা: শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব। রাষ্ট্রের বিবর্তনে রাজনৈতিক চেতনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যে মুহুর্তে মানুষ শিক্ষিত ও সচেতন হয়েছে, সেই মুহূর্তে সমাজ বদলে গেছে। মানুষ বুঝতে পেরেছে যে সমাজের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একজন বা কয়েকজনকে মানতে হবে। এভাবে একদিন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

মূল্যায়ন: ঐতিহাসিক মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত একমাত্র গ্রহণযোগ্য মতবাদ। এই মতবাদ বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক। এই মতবাদটি উপাখ্যানমূলক তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট দিনে দুর্ঘটনাক্রমে বা কোনো বিশেষ কারণে বা কোনো বিশেষ উপাদান দ্বারা অস্তিত্বে আসেনি। সামাজিক বিবর্তনের একটি বিশেষ পর্যায়ে একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র মানব সমাজের ক্রমাগত বিকাশের ফল।

0 মন্তব্যসমূহ