রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা যখন শুধু মাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে তখন তাকে এককেন্দ্রিক সরকার বলে।
এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় শাসনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে। এই ব্যবস্থায় প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সরকারের অস্তিত্ব থাকতে পারে, তবে তা কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট হিসাবে কাজ করে। ফ্রান্স, জাপান, ব্রিটেন, যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশ এককেন্দ্রিক সরকারের উদাহরণ।এককেন্দ্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
এককেন্দ্রিক সরকারের কতকগুলাে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিম্নে তা আলােচনা করা হলাে-
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাধান্যঃ এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার দেশের সমগ্র শাসনকার্যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। কেন্দ্রীয় সরকারই কেবল সরকার পরিচালনায় সকল প্রকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এতে প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সরকারের কোন ভূমিকা নেই।
সুপরিবর্তনীয় সংবিধানঃ এককেন্দ্রিক সরকারের সংবিধান সাধারণত সুপরিবর্তনীয় হয়। এতে সংবিধানের ধারাসমূহ পরিবর্তন করতে কোন জটিল পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয় না।
দুর্বল বিচার বিভাগঃ এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের প্রাধান্য অনুপস্থিত। কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। যার ফলশ্রুতিতে বিচার বিভাগ দুর্বল হয়ে পড়ে।
কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্যঃ অধ্যাপক ডাইসি বলেন, “এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলাে কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রাধান্য।” কেন্দ্রীয় আইনসভা যে কোন আইন প্রণয়ন বা রদ করতে পারে। এখানে সংবিধানের পরিবর্তে আইনসভার প্রধান্যকে মেনে নেয়া হয়। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন সকল সংস্থা বা আঞ্চলিক সরকারসমূহ পালন করতে বাধ্য থাকে।
লিখিত ও অলিখিত সংবিধানঃ এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থার সংবিধান লিখিত হতে পারে আবার অলিখিতও হতে পারে। যেমন- ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত, আবার ফ্রান্সের সংবিধান লিখিত।
আঞ্চলিক সরকার গঠনঃ এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় প্রশাসনিক কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কতকগুলাে আঞ্চলিক সরকার গঠন করতে পারে। আর আঞ্চলিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। আঞ্চলিক সরকারের কোন স্বাধীন অস্তিত্ব বা স্বাতন্ত্র নেই।
একক আনুগত্যঃ এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলাে এতে নাগরিকগণ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি একক আনুগত্য প্রদর্শন করে। কেননা এরকম শাসনব্যবস্থায় দ্বৈত নাগরিকতার কোন স্থান নেই।
সহজেই দখলযােগ্যঃ এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় আদালত কর্তৃপক্ষের কোন হস্তক্ষেপ না থাকায় কেন্দ্র ও বাইরে থেকে যে কেউ অতি সহজেই ক্ষমতা দখল করতে পারে।
নমনীয়তাঃ এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা নমনীয় প্রকৃতির হয়ে থাকে। যে কোন জরুরি অবস্থা বা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে এ সরকার যুগােপযােগী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়বহুলঃ এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় সমগ্র দেশব্যাপী একটিমাত্র সরকার বিদ্যমান থাকে। সুতরাং এ সরকার ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল হয়।
ঐক্যের প্রতীকঃ এ সরকার ব্যবস্থা জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। এ ধরনের সরকার ব্যবস্থায় সমগ্র জনসমষ্টি একটিমাত্র কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি নিরঙ্কুশভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে। তাই তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যবােধ সদ্য হয়।
ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্য বিশেষভাবে প্রযােজ্যঃ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্য এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা বিশেষ উপযােগী। রাষ্ট্র ক্ষুদ্র হলে কেন্দ্র থেকেই সমগ্র দেশে কর্তৃত্ব করা সম্ভব হয়। আয়তনে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলাের জন্য আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের প্রয়ােজন পড়ে না। সুতরাং বলা যায়, এককেন্দ্রিক সরকার ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্যই বিশেষভাবে প্রযােজ্য।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অভাবঃ এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রদেশ বা অঞ্চলগুলােতে স্বায়ত্তশাসন স্বীকৃত নয়। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার এদের কাজে হস্তক্ষেপ করে থাকে।
কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাঃ এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় সকল ক্ষমতা কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত হয়। আঞ্চলিক সরকারকে তাদের ক্ষমতা পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল হতে হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলাের মাঝেই এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রকৃত পরিচয় নিহিত রয়েছে। কেন্দ্রের প্রাধান্য অতিমাত্রায় হওয়ায় এ সরকার ব্যবস্থা অন্যান্য সরকার ব্যবস্থা থেকে আলাদা। এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে বর্তমানে এ সরকারের গ্রহণযােগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ