সামন্ততন্ত্র বলতে কী বোঝো?


পঞ্চম শতকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয় তার সূত্র ধরেই পশ্চিম ইউরোপে এক কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যেখানে আঞ্চলিক শাসনকর্তারাই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে থাকে। অর্থাৎ নগরসভ্যতার অবক্ষয়ের পরবর্তীকালে মধ্যযুগের ইউরোপে জমিকেন্দ্রিক যে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তা সামন্ততন্ত্র বা Feudalism নামে পরিচিত হয়।


সামন্ততন্ত্র শব্দের অর্থ: সামন্ততন্ত্র বা ‘Feudalism' শব্দটির উৎস ল্যাটিন শব্দ ‘Feodalis' এবং ফরাসি শব্দ ‘Feodalite' এটি সর্বপ্রথম ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে ব্যবহৃত হলেও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রথম উপলব্ধি করেন বিশিষ্ট ফরাসি ঐতিহাসিক বোলাভিয়ের (Boulanvilliers)।

সামন্ততন্ত্রের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মত:
বোলাভিয়ের মত: বিশিষ্ট ফরাসি ঐতিহাসিক বোলাভিয়ের সামন্ততন্ত্রকে মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম বলে উল্লেখ করে এর সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন সেটি হল, সামন্ততন্ত্র হল সার্বভৌম অধিকারের বিভাজন।

কার্ল মার্কসের মত: কার্ল মার্কস সামন্ততন্ত্রের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, যে সমাজব্যবস্থায় শাসক শ্রেণি স্বাধীনতাহীন শ্রমজীবী মানুষের শ্রমকে ব্যবহার করে কৃষিকাজ ও হস্তশিল্পের মাধ্যমে শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন করে, তাকে সামন্ততন্ত্র বলা হয়।

মার্ক ব্লখের মত: ঐতিহাসিক মার্ক ব্লখ তাঁর 'Feudal Society' শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, যাজক ও কৃষক শ্রেণিকে নিয়ে ম্যানরকে কেন্দ্র করে যে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তাকে সামন্ততন্ত্র বলা হয়।

মরিস ডবের মত: মার্কসবাদী ঐতিহাসিক মরিস ডব তাঁর Studies in the Development of Capitalism' গ্রন্থে সামন্ততন্ত্রকে একটি উৎপাদক ব্যবস্থা বা mode of production বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি সামন্তপ্রথাকে ভূমিদাস প্রথার প্রায় সমার্থক হিসেবে দেখিয়েছেন।

উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলি এবং অন্যান্য বিশিষ্টজন (যথা—পেরি অ্যান্ডারসন, অঁরি পিরেন, অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ) প্রদত্ত সংজ্ঞার নিরিখে সামন্ততন্ত্রের একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা যায় যে, মধ্যযুগে পশ্চিম ইউরোপে জমির উপর বিশেষ অধিকারের ভিত্তিতে যে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তাকে সামন্ততন্ত্র বা Feudalism বলা হয়।



পশ্চিম ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের মুখ্য বৈশিষ্ট্য:
পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামন্ততন্ত্রের কিছু আঞ্চলিক বৈচিত্র্য থাকলেও এই ব্যবস্থার কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়—

কেন্দ্রীয় দুর্বলতা: ৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ভার্দুনের বণ্টনের পর কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে বিভিন্ন বহিরাগত জাতির আক্রমণে ইউরোপের শক্তিশালী সাম্রাজ্যের কাঠামো ভেঙে পড়ে। একে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক শাসকরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় শাসকও আঞ্চলিক সামন্তপ্রভুদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

স্থবির অর্থনীতি: ঐতিহাসিক অঁরি পিরেন দেখিয়েছেন যে, মধ্যযুগে ইসলামীয় আগ্রাসনের ফলস্বরূপ ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের পতন ও তার থেকে নগরের অবক্ষয় ঘটলে গ্রামগুলি সমৃদ্ধ হয়। গ্রামগুলি নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদন করতে শুরু করলে স্থবির অর্থনীতির জন্ম হয়।

কৃষির অনগ্রসরতা: প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মরিস ডব-এর মতে, আলোচ্য কালপর্বে সামন্তপ্রভুরা উন্নতমানের কৃষি প্রযুক্তি ও অর্থকরী ফসল চাষে উৎসাহী না হলে কৃষিজ উৎপাদন ব্যাহত হয়।

জমির গুরুত্ব: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামন্তপ্রভুদের মর্যাদা ও শক্তির যাবতীয় আধার ছিল জমি। যে প্রভুর অধীনে যত বেশি সংখ্যক জমি থাকত সে তত বেশি সংখ্যক ভ্যাসাল ও ভূমিদাস নিয়োগ করতে পারত। মধ্যযুগীয় ইউরোপে এভাবেই জমিকে কেন্দ্র করে উৎপাদন ব্যবস্থা ও আর্থসামাজিক কাঠামোর ভিত্তি রচিত হয় যা ছিল সামন্ততন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

এ ছাড়া অধীনস্থ কৃষক শ্রেণির অস্তিত্ব, ম্যানর প্রথা, শিক্ষিত যোদ্ধা শ্রেণি, ঊর্ধ্বতনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন, শোষণমূলক করব্যবস্থা—এগুলি ইউরোপের সামন্ততন্ত্রকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করতে সহায়তা করেছিল।

0 মন্তব্যসমূহ