ম্যানর প্রথা ছিল তৎকালীন ইউরোপীয় কৃষি সমাজের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ কাঠামো। ম্যানর প্রথার মাধ্যমে সামন্ততন্ত্রের কৃষি ব্যবস্থায় যে অর্থনীতি ছিল তা নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ম্যানর ছিল মূলত দুই একটি গ্রামের সম্মিলিত রূপ।
মধ্যযুগে ইউরোপে দাস বিপ্লবের (Slave revolution) পর সকল দাসরা ধীরে ধীরে মুক্তি পেয়ে নিজেদের কে স্বাবলম্বী করার জন্য হাল-চাষ শুরু করে। এতে জমিদাদের দাসের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তাদের সামাজিক শক্তি দিন দিন কমে আসতে থাকে। জমিদাদরা তাদের শক্তি বজায় রেখে দাসদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য মধ্যযুগের মাঝামাঝি সময়ে সামন্ততন্ত্র এবং ম্যানর প্রথার উদ্ভব ঘটায়।ম্যানরে যারা চাষাবাদ করত তাদেরকে ভূমিদাস বলা হতো। আর যারা জমির মালিক ছিল তাদের সামন্ত প্রভু বলা হত। কৃষক বা দাসদের জমি না থাকার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সামন্ত প্রভুরা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এক সংমিশ্রণ ঘটিয়ে একটি অভিনব প্রথার উদ্ভব ঘটায় যা ম্যানর প্রথা নামে পরিচিত।
মধ্যকালীন ইউরোপে কৃষিভিত্তিক সমাজের একটি অর্থনৈতিক সংগঠন হিসেবে ম্যানর প্রথার বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
ক্ষুদ্র রাষ্ট্র: মধ্যযুগে পশ্চিম ইউরোপের ভঙ্গুর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও দুর্বল অর্থনীতির ফলে ম্যানরগুলিকে কেন্দ্র করে এক একটি স্বশাসিত অঞ্চল গড়ে উঠেছিল। এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অর্থাৎ ম্যানরগুলি উৎপাদন ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনার পাশাপাশি শান্তি প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তা রক্ষা ও বিচারকার্য সম্পাদন করত।
ম্যানর হাউস গঠন: প্রত্যেকটি ম্যানরেই একটি করে ম্যানর হাউস থাকত। এখানে সামন্তপ্রভু ও তার পরিবার-সহ আত্মীয়পরিজন, প্রজাবর্গ, কর্মচারীরা বসবাস করত। কৃষিভূমির পাশাপাশি প্রতিটি ম্যানরে ফল ও ফুলের বাগান, পশুচারণভূমি থাকত। ম্যানর হাউসের অভ্যন্তরে থাকত ম্যানর মালিকের শয়নকক্ষ, খাবার ঘর, কর্মচারীদের কক্ষ প্রভৃতি।
ম্যানরগুলির স্বয়ংসম্পূর্ণতা: সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোতে প্রতিটি ম্যানর ছিল এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ একক। তাই লক্ষ করা যায় যে, প্রতিটি ম্যানরে বিভিন্ন সময়ে শস্যবপনের উপযুক্ত জমি থাকার পাশাপাশি শস্যাগার, কামারশালা, শস্যপেষাই কল, ফলের বাগান, পশুচারণক্ষেত্র, জলাশয়, চার্চ, রুটি তৈরির কারখানা প্রভৃতি থাকত।
ম্যানরের জমির প্রকারভেদ: প্রতিটি ম্যানরে যে বিপুল পরিমাণ জমি থাকত তার মধ্যে কৃষিজমি, চারণভূমি, অনাবাদী জমি, বনভূমি, ফলের বাগান, জলাশয়, ম্যানর প্রভু ও কৃষকদের বাসস্থান, চার্চ সবই ছিল। চাষযোগ্য জমিকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হত—
(১) ম্যানর প্রভুর নিজস্ব খাসজমি বা ডিমেইন।
(২) কৃষকদের প্রদেয় চাষযোগ্য জমি বা বসতি।
এক্ষেত্রে ম্যানর প্রভু অর্থাৎ সামন্তপ্রভু নিজের জন্য কিছু আবাদযোগ্য জমি রেখে বাকি জমি অধীনস্থ কৃষকদের মধ্যে আনুগত্যের বিনিময়ে বণ্টন করতেন। জমিলাভের বিনিময়ে কৃষক সামন্তপ্রভুকে উৎপাদনের একটি অংশ দিতে বাধ্য থাকত। এ ছাড়া সামন্তপ্রভু নিজের জমি স্বাধীন কৃষক ও সার্ফ বা ভূমিদাসদের দ্বারা বিনা পারিশ্রমিকে চাষ করতেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ম্যানর প্রথা ছিল সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থার পরিচালিকাস্বরূপ।
0 মন্তব্যসমূহ