ভারতে প্রাচীন যুগের অবসানের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের সূচনা হয় অষ্টম শতাব্দীতে। সাধারণভাবে ৭১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে মহম্মদ-বিন-কাশিম কর্তৃক সিন্ধু জয়ের মাধ্যমে ভারতে মুসলিমদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়কালকে মধ্যযুগ বলে চিহ্নিত করা যায়। সেজন্য এই যুগটিকে মুসলিম যুগও বলা হয়। এই সময় একদিকে ভারতের যেমন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঐক্যবদ্ধতা এসেছিল অন্যদিকে সুসংহত রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে উঠেছিল।
ভারতের মধ্যযুগের যেসব বৈশিষ্ট্য গুলি আমরা লক্ষ্য করি তা নিম্ন আলোচনা করছি;
প্রথমতঃ আদি মধ্য যুগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলিতে সপরিষদ রাজতন্ত্র ছিল প্রধান রাজনৈতিক অবস্থা। রাজতন্ত্র ছিল মূলত বংশানুক্রমিক। কোন কোন রচনাই নির্বাচিত রাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু উদগাঁওকারের মতো ঐতিহাসিকদের মতে, কোন অস্বাভাবিক ঘটনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতার পরিবর্তনকে বৈধতা দেবার জন্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ সুলতানী পর্বে শাসক বাছাইকরণের ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট নীতি গড়ে ওঠেনি। কখনও বংশানুক্রমিকভাবে, কখনও অভিজাত গোষ্ঠী কর্তৃক মনোনয়নের মাধ্যমে, কখনও অস্ত্রবলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা হয়েছে। একারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজতন্ত্র ছিল অস্থায়ী। কিন্তু মুঘল পর্বে স্থায়ী রাজতন্ত্রের গঠন হয়।
তৃতীয়তঃ সুলতানী পর্বের শাসকগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিজাত গোষ্ঠী বিশেষত উলেমা, কাজী, আমীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতেন। বারানী রাজনীতি এবং ধর্মকে যমজভাই হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। রাজা বিজ্ঞ ধার্মিক ব্যক্তিদের পরামর্শ অনুযায়ী রাজকার্য পরিচালিত করতে।
চতুর্থতঃ সুলতানী শাসনব্যবস্থায় শাসকগণের কাছে রাজনৈতিক বৈধতার প্রশ্নে খলিফা কর্তৃক অনুমোদন নেবার ব্যাপারটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মুঘল শাসকগণ নিজেদের চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে গণ্য করায় খলিফার কাছ থেকে বৈধতা আদায় থেকে বিরত থাকেন।
পঞ্চমতঃ মধ্যযুগের তাত্ত্বিকগণ রাজতন্ত্রের ঐশ্বরিক তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। আবুল ফজল শাসককে ঈশ্বরের দ্যুতি হিসাবে ব্যাখ্যা করেন এবং মনে করেন ঈশ্বর/সূর্য কর্তৃক বিচ্ছুরিত আলো কোন মাধ্যম ব্যতিরেকে শাসকের অন্তরে প্রবেশ করে। এ কারণে রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিচ্ছায়া। সুতরাং রাজার ক্ষমতা উলেমা বা অন্য কোন ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। রাজা সরাসরি ঈশ্বরের কাছেই দায়বদ্ধ।
ষষ্ঠতঃ আবুল ফজল রাজাকে শুধুমাত্র পার্থিব ব্যাপারেই প্রধান বলে চিহ্নিত করেননি। তিনি রাজাকে প্রজাদের আধ্যাত্মিক পদপ্রদর্শক হিসাবেও ব্যাখ্যা করেছেন। প্রজানুরঞ্জনই রাজার অন্যতম দায়িত্ব। তিনি নির্দিষ্ট কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রক্ষক নন — তিনি সমগ্র রাজ্যের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের রক্ষক।
সপ্তমতঃ আবুল ফজলের রচনায় এবং আকবরের কর্মজীবনে ইসলামের সঙ্গে ইসলামপূর্ব ভারতীয় ঐতিহ্যের সংমিশ্রণের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। বেশ কিছু ইসলামপূর্ব ভারতীয় রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও ব্যবস্থাদি আবুল ফজলের রচনা ও আকবরের কর্মজীবনকে প্রভাবিত করে।
0 মন্তব্যসমূহ