বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে অন্যতম হল হরপ্পা সভ্যতা। সিন্ধু ও তার উপনদী ইরাবতীর তীরে গড়ে উঠেছিল এই সুপ্রাচীন সভ্যতা। হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা মূলত কৃষি ও পশুপালন ভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও বাণিজ্যও এই সভ্যতার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল।
পশুপালন: হরপ্পাবাসীদের অর্থনীতিতে পশুপালনের বিশেষ ভূমিকা ছিল। হরপ্পাবাসীদের গৃহপালিত পশু ছিল গোরু-মহিষ, ভেড়া, ছাগল, শূকর ও উট। প্রয়োজনে তারা গৃহপালিত পশুদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। এ ছাড়াও তারা গোরু ও মহিষকে চাষে লাঙল টানার কাজে ব্যবহার করত।কৃষিকাজ: সিন্ধুর উভয় তীরে উর্বর সমভূমিতে প্রথমে গম আর যব চাষ শুরু হয়। হরপ্পাবাসীদের প্রধান প্রধান কৃষিজাত ফসল ছিল গম, যব, তিল, মটর, রাই, বাদাম প্রভৃতি। অন্যান্য কৃষিজাত ফসলের মধ্যে ছিল বাজরা, ধান, নানা ধরনের কলাই এবং কার্পাস।
শিল্প-কারিগরি: সিন্ধু সভ্যতায় তিন ধরনের শিল্পের অস্তিত্ব ছিল।
- ধাতুশিল্প: সিন্ধু অঞ্চলে লোহার কোনো চিহ্ন না পাওয়া গেলেও তামা ও ব্রোঞ্জের বর্শা, কুঠার, বড়শি, করাত, ছুঁচ, দাঁড়িপাল্লা প্রভৃতি নিদর্শন পাওয়া গেছে। ধাতুশিল্পের মধ্যে সোনা ও রুপোর অলংকার নির্মাণশিল্পের প্রচলন ছিল।
- মৃৎশিল্প: হরপ্পার মৃৎশিল্পীরা পলিমাটি, বালি ও চুনের গুঁড়ো মিশিয়ে কলশি, জালা, থালা, পেয়ালা, ডেকচি, বয়াম প্রভৃতি নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি ও নানাপ্রকার খেলনা তৈরি করত।
- বস্তুবয়নশিল্প: সিন্ধু উপত্যকার বসতি এলাকা থেকে পোড়ামাটি ও বিভিন্ন ধরনের বস্তুর মিশ্রণ দিয়ে তৈরি তকলি মিলছে। এই যন্ত্রের সাহায্যে হাত দিয়ে সুতো কাটা হত বলে মনে করা হয়। মহেনজোদারোয় প্রাপ্ত রঙিন কাপড়ের টুকরোটি এখনও পর্যন্ত বিশ্বের প্রাচীনতম সুতি কাপড়ের নিদর্শন। সিন্ধু সভ্যতায় যে পুরোহিত রাজার পাথরের মূর্তিটি পাওয়া গেছে, তার পোশাকে ছুঁচ দিয়ে করা যে অলংকরণ বা নকশা দেখা যায়, তা উন্নত সূচিশিল্পের পরিচায়ক।
ব্যাবসাবাণিজ্য: সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলের অধিবাসীরা স্থলপথ ও জলপথ— উভয় মাধ্যমেই অন্তর্বাণিজ্য এবং বহির্বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্থলপথই ছিল প্রধান। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে আমদানিকৃত দ্রব্যের মধ্যে অন্যতম ছিল— সোনা, তামা, সিসা, চুনাপাথর, অ্যাগেট ও কার্লেনিয়ান জাতীয় দামি পাথর ইত্যাদি। রফতানিকৃত পণ্যের মধ্যে সম্ভবত কার্পাসজাত বস্ত্র, নানা ধরনের জপমালার পুঁতি, তামার অস্ত্রশস্ত্র ও যন্ত্রপাতি ছিল প্রধান। অন্যদিকে মিশর, সুমের, মেসোপটেমিয়া, ব্যাবিলন, পারস্য, বেলুচিস্তান ইত্যাদি অঞ্চলের সঙ্গে লোথাল বন্দরের মাধ্যমে বাণিজ্য চলত। লোথাল থেকে হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র, নানা মণিমুক্তো, সুতিবস্ত্র ইত্যাদি রফতানি করা হত। সুমের থেকে আমদানি করা হত রুপো। সিন্ধুর তুলোজাত সামগ্রী মেসোপটেমিয়ায় রফতানি করা হত। মুদ্রার প্রচলন না হওয়ায় বিনিময় প্রথার মাধ্যমে লেনদেন চলত। মাপ করার জন্য ব্রোঞ্জের মাপকাঠি এবং ওজনের জন্য বিভিন্ন আকারের বাটখারা পাওয়া গেছে।
0 মন্তব্যসমূহ