রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কি বিজ্ঞান পদবাচ্য; পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি:


রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা যেতে পারে কিনা এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এই মতবিরোধকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি। গ্রিক পন্ডিত অ্যারিস্টোটল রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে 'শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান' বলে অভিহিত করেছেন। তাঁকে অনুসরণ করেছেন মন্তেস্কু, হবস, ব্লুন্টসলি, লর্ড ব্রাইস প্রমুখ আধুনিক আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর। অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান না বলার যুক্তি দিয়েছেন– বাকল, কোঁত, মেটল্যান্ড প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।


রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলার পক্ষে যুক্তি:
সুসংবদ্ধ জ্ঞানার্জন সম্ভব:
অন্যান্য বিজ্ঞানের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরও পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা, শ্রেণি-বিভক্তকরণ প্রভৃতি পদ্ধতির সাহায্যে রাষ্ট্রের উৎপত্তি প্রকৃতি নাগরিকদের আচার-আচরণ প্রভৃতি সম্পর্কে সুসংবদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।

পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ সম্ভব:
অন্যান্য  বিজ্ঞানের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ও পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ সম্ভব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগন আদর্শ ও জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ছবি তুলে ধরেছেন।

সাধারণ সূত্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব:
সুসংবদ্ধ জ্ঞান থেকে কতকগুলি সাধারণ নিয়ম বা সূত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সেই সূত্রগুলি বা নিয়ম রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হতে পারে।

তত্ত্ব ও তথ্যের ওপর সমান গুরুত্ব:
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তত্ত্ব ও তথ্যের ওপর সমান গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কারণ, মার্ক্স-এঙ্গেলস কেবল তথ্য নয়, সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণের উপর ভিত্তি করেই সমাজবিকাশের ধারাটিকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

বিকাশের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা:
যেসকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধারাবাহিকতা নেই বলে মনে করেন, তাঁরা সমাজবিজ্ঞানের এই শাখাটির স্বরুপ  যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ জন্মলগ্ন থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান এক-একটি স্তর অতিক্রম করে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে।


রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান না বলার পক্ষে যুক্তি:
বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা:
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ব্যাপক, জটিল এবং অনিশ্চিত। পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যার বিষয়বস্তু গুলিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা যায় কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে তেমন  ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা সম্ভব হয় না।

ধারাবাহিকতার অভাব:
যেকোন বিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তার মধ্যে ধারাবাহিকতা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে এরূপ ধারাবাহিকতা একান্ত অভাব রয়েছে।

তথ্যের থেকে অনেক বেশি তত্ত্ব-নির্ভর:
অন্যান্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা তত্ত্ব ও তথ্যকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক অনুশীলন অপেক্ষা দার্শনিক চিন্তাভাবনা ও মতামতকে অধিক প্রাধান্য দেন। 

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করা অসম্ভব:
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনুসন্ধান ও পরীক্ষামূলক পদ্ধতি কখনোই  সঠিকভাবে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। কারণ মানুষ এবং মানুষ্য-সমাজই হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পক্ষে পরীক্ষামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা সম্ভব নয়, সম্ভব হলে তা বিপদজ্জনক। 

সুনির্দিষ্ট গবেষণা-পদ্ধতির অভাব:
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে গবেষণার কোন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগন সর্বসম্মত পদ্ধতি সৃষ্টি করতে পারেননি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সর্বপ্রধান অস্ত্র পরীক্ষা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই  অস্ত্র প্রয়োগ করার সুযোগ-সুবিধা অত্যন্ত কম।

  পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যার মতো বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বলা না গেলেও এটিকে সুসংগত সামাজিক বিজ্ঞান বলা যেতে পারে।  লর্ড ব্রাইস রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে 'একটি প্রগতিশীল বিজ্ঞান' বলেছেন।  

0 মন্তব্যসমূহ