উদারনীতিবাদ কাকে বলে? উদারনীতিবাদের মুখ্য বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা: (Liberalism).


উদারনীতিবাদ কাকে বলে?

উদারনীতিবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Liberalism. আবার বুৎপত্তিগত বিচারে Liberalism এর অর্থ হল Liberty বা স্বাধীনতা। তবে সাধারণভাবে বলা যায় যে, সব ধরনের কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে যে মতবাদ ব্যক্তিগত জীবনে স্বাধীন চিন্তা, বিশ্বাসের উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রধান উপায় বলে মনে করে এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীন মৌলিক নীতি প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়, তাকে উদারনীতিবাদ বলে অভিহিত করা যায়।

উদারনীতিবাদের তিনটি রূপ আছে।
এগুলি হল — (১) সনাতন উদারনীতিবাদ, (২) নয়া উদারনীতিবাদ, (৩) সংশোধনমূলক উদারনীতিবাদ।
J.S Mill, বেন্থাম, গ্রিন, লেসকি, রবার্ট ডাল প্রমুখরা হলেন উদারনীতিবাদের মুখ্য প্রবক্তা।

উদারনীতিবাদের যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আছে সেগুলি হল যথা—
উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য:
আইনের শাসন:
উদারনৈতিক মতবাদে আইনের শাসনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ব্যক্তির পৌর স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য আইনকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে এই দর্শনের প্রবক্তারা মনে করেন।

স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত:   
উদারনীতিবাদে ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রভৃতি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা গুলিকে অপরিহার্য বলে স্বীকার করা হয়েছে। সেইসাথে ব্যক্তির অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার কথাও স্বীকার করা হয়েছে।

রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা:   
উদারনীতিবাদের রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। সেইসাথে জনগণের সম্মতি ও শোষিতে সম্মতির ওপর সরকার গঠনের প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।

পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি:
উদারনীতিবাদের নাগরিকের পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার গুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জীবনের অধিকার, চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার, ধর্মের ও পরিবার গঠনের অধিকার প্রভৃতি হলো পৌর অধিকার। আর নির্বাচিত হওয়া ও নির্বাচন করার অধিকার হলো রাজনৈতিক অধিকার।

সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকারের পরিবর্তন:
উদারনীতিবাদে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের দ্বারা সরকারের পরিবর্তন শিক্ষিত হয়েছে। এর জন্য অবশ্য বিপ্লব ও হিংসার কথা স্বীকার করা হয়নি।

স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা:  
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা নাগরিকের মৌলিক অধিকার গুলিকে সংরক্ষন করে থাকে। এছাড়াও বিচারব্যবস্থা এখানে সংবিধানের ব্যাখ্যা কর্তা ও অভিভাবক রূপে কাজ করে থাকে।

প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকৃতি: উদারনীতিবাদের জাতি,ধর্ম,বর্ণ, দরিদ্র, স্ত্রী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শ্বেতকায়-কৃষ্ণকায় নির্বিশেষে সমস্ত সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার প্রদান এর নীতি কে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বীকৃতি:  
উদারনীতিবাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে জনগণের সম্পত্তির অধিকার না থাকলে তাদের কাজকর্মে উৎসাহ আসবে না এবং এর ফলে দেশের উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হয়।

অবাধ বাণিজ্যনীতি:
উদারনৈতিক মতবাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ বাণিজ্যের নীতিকে স্বীকার করে। অ্যাডাম স্মিথের মতে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতার ফলে সমাজের সর্বাধিক কল্যাণ সাধিত হয়।

সুতরাং আমরা বলতে পারি যে,উদারনীতিবাদের অর্থনৈতিক সাম্য উপেক্ষিত হয়েছে এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদকে সমর্থন করা হয়েছে। এর ফলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক সাম্য অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এমনকি বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতাও বাস্তবে ক্ষুন্ন হয়েছে। অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অন্যান্য স্বাধীনতা কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তবে  মানবতাবাদী ধ্যান-ধারণার প্রসার, ব্যক্তিস্বাধীনতার বিকাশ ও ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে মুক্ত রাখা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদ এর গুরুত্ব অপরিসীম।

0 মন্তব্যসমূহ