সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের গঠন-কাঠামো : (The formation-structure of the UNO).


সাধারণ সভা (General Assembly):

জাতিপুঞ্জের সনদের চতুর্থ অধ্যায়ে ৯ থেকে ২২ নং ধারায় সাধারণ সভা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। জাতিপুঞ্জের কেন্দ্রীয় আলোচনাস্থল হল সাধারণ সভা। সংগঠনের সকল সদস্যের সমান মর্যাদায় প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ এই সংস্থার রয়েছে। একে প্রতীকী অর্থে Town meeting of the World বলা হয়। এই সভার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৯৩। প্রত্যেক সদস্যরাষ্ট্র ৫ জন করে প্রতিনিধি সাধারণ সভার অধিবেশনে পাঠাতে পারে। সাধারণ সভায় ১ জন সভাপতি ও ২১ জন সহ-সভাপতি থাকেন। সনদে উল্লিখিত যে - কোনো বিষয়, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, নিরস্ত্রীকরণ, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়সমূহ নিয়ে সাধারণ সভা আলোচনা করতে পারে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে সাধারণ সভার অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে সদস্যরাষ্ট্রগুলি স্বচ্ছন্দে তাদের মতপ্রকাশ করতে পারে।

নিরাপত্তা পরিষদ (Security Council): জাতিপুঞ্জের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ও আলোচিত অঙ্গ বা সংস্থা হল নিরাপত্তা পরিষদ। এই পরিষদের উপরই শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রধান দায়িত্ব অর্পিত রয়েছে (Primary responsibilities for the maintenanceof international Peace and Security)। জাতিপুঞ্জের সনদের পঞ্চম অধ্যায়ে ২৩ থেকে ৩২ নং ধারায় নিরাপত্তা পরিষদের গঠন ও কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে স্থায়ী সদস্যের সংখ্যা ৫ এবং অস্থায়ী  সদস্যের সংখ্যা ১০।
স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলি হল— আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং চিন।
১০ টি অস্থায়ী সদস্যের মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির জন্য নির্দিষ্ট থাকে ৫ টি আসন, পশ্চিম ইউরোপ ও অন্যান্য দেশ থেকে ২ টি, লাতিন আমেরিকা থেকে ২ টি এবং পূর্ব ইউরোপ থেকে ১ টি অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়।
নিরাপত্তা পরিষদ সারা বছরই যে -কোনো সময় যে -কোনোদিন বৈঠক আহ্বান করতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যগণ বছরে একবার নিউ ইয়র্কে (এপ্রিল) ও একবার জেনেভাতে (জুলাই) অধিবেশন আহ্বান করে। এই অধিবেশনে পরিষদের অধীন সকল কমিশন ও কমিটির কার্যবিবরণী আলোচনা করা হয়। নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান কর্তব্য হল বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (Economic and Social Council):
জাতিপুঞ্জের সনদের দশম অধ্যায় ৬১ থেকে ৭২নং ধারায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এর বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫৪। প্রতি বছর ১৮ জন সদস্য অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৮ জন নতুন সদস্য নির্বাচিত হন। প্রত্যেক সদস্য ৩ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তবে কার্যকাল শেষ হওয়ার পর তাঁরা পুনর্নির্বাচিত হতে পারেন।
এই সংস্থার প্রধান কর্তব্য হল— আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সমীক্ষা করে সাধারণ সভা, নিরাপত্তা পরিষদ বা সংশ্লিষ্ট বিশেষ সংস্থাসমূহের কাছে নিজের সুপারিশ পেশ করা।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ নিজের কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য অনেক কমিটি ও কমিশন গঠন করেছে।
কমিটিগুলির মধ্যে অন্যতম হল
  • Negotiation Committee.
  • Programme Committee.
  • Committee on Non-Governmental Organisation.
  • Industrial Development Committee.
অপরদিকে, কমিশনের মধ্যে অন্যতম হল
  • Functional Commission.
  • Regional Economic Commission.

অছি পরিষদ (Trusteeship Council):
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদের ত্রয়োদশ অধ্যায় ৮৬ থেকে ৯১ নং ধারার মধ্যে আন্তর্জাতিক অছি ব্যবস্থা সম্পর্কিত নিয়মকানুনগুলি আলোচিত হয়েছে। অনুন্নত দেশগুলিকে স্বায়ত্তশাসনের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য ১৫ জন সদস্যবিশিষ্ট যে পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা রয়েছে, তাই অছি পরিষদ নামে পরিচিত। অনগ্রসর জাতিসমূহের তত্ত্বাবধানে কাজ করে এই অছি পরিষদ।
অছি পরিষদ তিন প্রকার সদস্য নিয়ে গঠিত — 
  • অছি অঞ্চলগুলির প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্র।
  • নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যবৃন্দ।
  • সাধারণ সভা কর্তৃক নির্বাচিত সদস্যগণ।
অছি পরিষদ মূলত অছি অঞ্চলের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ের প্রতিবেদন সাধারণ সভার কাছে পেশ করে। 

আন্তর্জাতিক বিচারালয় (International Court of Justice):
সনদের ২ নং ধারায় আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের গঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে। সনদের শুনং ধারানুসারে ১৫ জন বিচারপতিকে নিয়ে এই আদালত গঠিত হয়। বিচারপতিগণ ৯ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। প্রতি ৩ বছর অন্তর ৫ জন বিচারপতি অবসর গ্রহণ করেন এবং ৫ জন নতুন বিচারপতি নিযুক্ত হন। আন্তর্জাতিক আদালত প্রধানত আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইনের ব্যাখ্যা, আন্তর্জাতিক দায়দায়িত্ব লঙ্ঘন, আন্তর্জাতিক দায়িত্বভঙ্গের ক্ষতিপূরণের পরিমাপ নির্ধারণ প্রভৃতি কর্তব্য পালন করে থাকে।
আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের কর্মপরিধিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়, যথা— 
  • স্বেচ্ছামূলক এলাকা (আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের কাছে বিবদমান পক্ষগুলির সম্মতিক্রমে আনীত সকল মামলাই এই এলাকার অন্তর্ভুক্ত)।
  • আধা-আবশ্যিক এলাকা (সন্ধি বা চুক্তিপত্রের ব্যাখ্যাদান এই এলাকাভুক্ত একটি ক্ষমতা)।
  • পরামর্শদান এলাকা (কোনো ক্ষেত্রে আইনগত সমস্যা দেখা দিলে সাধারণ সভা, নিরাপত্তা পরিষদ এবং অন্যান্য সংস্থা এমনকি বিশেষজ্ঞ সংস্থাগুলিও এই এলাকায় অংশগ্রহণ করতে পারে)।

কর্মদপ্তর বা সচিবালয় (Secretariat):
সনদের ৯৭ নং ধারায় বলা হয়েছে, মহাসচিব এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কর্মীবৃন্দকে নিয়ে কর্মদপ্তর বা সচিবালয় গঠিত হবে। মহাসচিব হলেন কর্মদপ্তরের প্রধান। তাঁর অধীনে ৮ টি বিভাগ। 
এই বিভাগগুলি হল-
  1. সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়ক বিভাগ।
  2. অর্থনৈতিক বিভাগ।
  3. আইন সংক্রান্ত বিভাগ।
  4. সামাজিক বিভাগ।
  5. অছি ব্যবস্থা বিষয়ক বিভাগ।
  6. জনতথ্য সম্পর্কিত বিভাগ।
  7. সাধারণ পরিসেবা ও সম্মেলন বিষয়ক বিভাগ।
  8. আর্থিক ও প্রশাসনিক পরিসেবা সংক্রান্ত বিভাগ।
প্রতিটি বিভাগে ১ জন করে উপমহাসচিব থাকেন। তাঁদের সাহায্য করার জন্য কয়েকজন সহকারী মহাসচিব থাকেন।
জাতিপুঞ্জের প্রথম মহাসচিব ছিলেন ট্রিগভি লি।
বর্তমান মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুটারেস।
মহাসচিবের প্রধান কাজ হল কর্মদপ্তরের কর্মচারীদের নিয়োগ ও অপসারণ, জাতিপুঞ্জের বিভিন্ন বিভাগের বৈঠকের ব্যবস্থা করা ও তাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করা, সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদের বিভিন্ন অধিবেশনের কর্মসূচি নির্ধারণ করা ইত্যাদি।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রতিষ্ঠার সময় পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের অধিবাসী স্বাধীনতা লাভের উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। তাদের স্বায়ত্তশাসন লাভের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাদের কয়েকটি বৃহৎ শক্তির শাসনাধীনে রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বৃহৎ বিদেশি শক্তিরশাসনাধীনে থেকে যাতে তারা শোষণ ও অত্যাচারমুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে, সেই ব্যবস্থা করবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ। সানফ্রান্সিসকো সম্মেলনে ঘোষণা করা হয় যে , স্বাধীনতা লাভের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হলে তবেই ওইসব অঞ্চল স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে। এই ব্যবস্থা অছি ব্যবস্থা (Trusteeship System) নামে পরিচিত।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদর দপ্তর:
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদর দপ্তর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রথম মহাসচিব: সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রথম মহাসচিব ছিলেন নরওয়ের ট্রিগভি লি (Trygve Lie)।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের বর্তমান মহাসচিব: সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের বর্তমান মহাসচিব হলেন পোর্তুগালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টোনিও গুটারেস (Antonio Guterres)। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি তিনি নবম মহাসচিবের কার্যভার গ্রহণ করেন।

0 মন্তব্যসমূহ