লোকপাল (Lokpal):

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে সুনিশ্চিত করার জন্য জন অভিযোগকে যথাযত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। এই উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম স্ক্যানডিনেভীয় প্রতিষ্ঠান ওমব্যাডসম্যান (Ombudsman) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮০৯ সালে সুইডেনে। ওমব্যাডসম্যান -এর ভারতীয় রূপ হল লোকপাল/লোকায়ুক্ত।


আজ আমরা এখানে লোকপাল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো—

লোকপাল (Lokpal):
ভারতে, ১৯৬০ -এর দশকের গোড়ার দিকে তৎকালীন আইনমন্ত্রী অশোক কুমার সেন সংসদে প্রথম সাংবিধানিক লোকপাল ধারণাটি প্রস্তাব করেছিলেন। লোকপাল এবং লোকায়ুক্ত শব্দদুটি সর্বপ্রথম ডঃ এল. এম. সিংভি অবতারণা করেছিলেন। ভারতে আন্না হাজারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক লড়াই শুরু করলে লোকপাল ও লোকায়ুক্ত আইন, ২০১৩ সালে পাশ হয়। এই আইন ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪ কার্যকরী হয়। The Lokpal and Lokayuktas (Amendment) Bill, ২০১৬ সংসদে পাশ হয় ২০১৬ সালের জুলাই মাসে।

লোকপালের Logo:
এর মধ্যে রয়েছে অম্বুডসম্যানের আকার (বিচারকগণের বেঞ্চ), জনগণ (তিনজন মানব ব্যক্তিত্ব), নজরদারি (একটি অশোক চক্র দ্বারা চোখের গঠন), আইন (একটি বইয়ের আকার) এবং বিচারিক (নীচে দুটি তে -রঙ্গা হাত ভারসাম্য অবস্থায় রাখা)। লোগোটির নকশা উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজের বাসিন্দা প্রশান্ত মিশ্র অঙ্কন করেছেন।



লোকপালের Motto:
Ma Gridhah Kasyasvidhanam (কারো সম্পদের লোভ করবেন না)।

লোকপালের গঠন:
একজন চেয়ারপার্সন ও সর্বাধিক ৮ (আট) জন সদস্য নিয়ে লোকপাল গঠিত হবে।

লোকপালের সদস্য:
  • ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি হবেন।
  • সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারক।
  • অনবদ্য নিষ্ঠা ও অসামান্য দক্ষতা সম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি, দুর্নীতি দমন নীতি সম্পর্কিত বিষয়ে ন্যূনতম ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা, জন প্রশাসন, সতর্কতা, বীমা এবং ব্যাঙ্কিং, আইন ও পরিচালনা সহ ফিনান্স বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান এবং দক্ষতা থাকা উচিত।
  • সদস্যের মধ্যে অর্ধেক বিচারিক (judicial) সদস্য এবং ন্যূনতম ৫০ % সদস্য এসসি/এসটি/ওবিসি/সংখ্যালঘু এবং মহিলা প্রতিনিধি হবেন।
  • কোনো জনপ্রতিনিধি বা চাকুরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন এরকম ব্যাক্তি লোকপালের সদস্য হতে পারবেন না।

লোকপালের প্রথম চেয়ারপার্সন:
সুপ্রীমকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি পিনাকী রঞ্জন ঘোষ ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন।

লোকপালের কার্যকাল:
লোকপাল চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ ১ বছর বা ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত।

লোকপালের সদস্যদের বেতন ও ভাতা:
চেয়ারপার্সনের বেতন ও ভাতা ভারতের প্রধান বিচারপতির সমতুল্য (২,৮০,০০০ টাকা/মাসে) এবং অন্যান্য সদস্যদের সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতির সমান (২,৫০,০০০ টাকা/মাসে)।  বেতন ও ভাতা Consolidated Fund of India থেকে মেটানো হয়।

লোকপালের সদস্যদের নিয়োগ:
সদস্যগণ একটি সিলেকশন কমিটির সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন।  সিলেকশন কমিটির চেয়ারপারসন হলেন — প্রধানমন্ত্রী। এছাড়াও লোকসভার স্পিকার, লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেতা, ভারতের প্রধান বিচারপতি বা তাঁর মনোনীত এবং একজন বিশিষ্ট বিচারপতি বা কোনো বিচারক।

লোকপালের ক্ষমতা ও কার্যাবলী:
● লোকপালের এখতিয়ারে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, গ্রুপ এ, বি, সি এবং ডি অফিসার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আধিকারিকরা অন্তর্ভূক্ত রয়েছেন।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সুরক্ষা, পাবলিক অর্ডার, পারমাণবিক শক্তি ও মহাকাশ সম্পর্কিত দুর্নীতির অভিযোগ বাদে অন্যান্য দুর্নীতি বিষয়ে লোকপালের এখতিয়ারের প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সংসদে বা সেখানে উল্লেখিত কোনো ভোটদানের বিষয়ে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের কার্যকলাপের ওপর লোকপালের কোনো এখতিয়ার নেই।

লোকপাল আইন অনুযায়ী সমস্ত সরকারি আধিকারিককে তাদের নিজের ও তাঁর ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সম্পদ এবং দায়বদ্ধতার হিসেব পেশ করতে হবে (furnish the assets and liabilities of themselves as well as their respective dependents)।

লোকপালের এক্তিয়ার সি.বি.আই. ও অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থার ওপরও প্রযুক্ত হবে। সাধারণভাবে কোনো দুর্নীতির তদন্ত ৬ মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে। তবে লোকপাল মনে করলে সময়সীমা বাড়াতে পারেন।

লোকপালের অনুসন্ধান শাখা একটি দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা ভোগ করে।

দুর্নীতির অভিযোগে যুক্ত সরকারি কর্মচারীর বদলী বা সাসপেনশনের সুপারিশ করার ক্ষমতা লোকপালের রয়েছে।

সীমাবদ্ধতা:
  • সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হল লোকপালের আওতা থেকে বিচার বিভাগকে বাদ দেওয়া।
  • লোকপালকে কোনো সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া হয়নি এবং লোকপালের বিরুদ্ধে আপিল করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
  • দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ অপরাধটি সংঘটিত হওয়ার সাতবছর অতিক্রম করলে নিবন্ধন করা যাবে না।

0 মন্তব্যসমূহ