স্বামী বিবেকানন্দ নরেন্দ্র নাথ দত্ত নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি একজন অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব ছিলেন যার বক্তৃতা, লেখা, চিঠি এবং কবিতা শুধুমাত্র ভারতের যুবকদেরই নয়, সমগ্র বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তার প্রচণ্ড বুদ্ধি ছিল ও তার বিশেষ প্রয়াস আজও আমাদের আলোকিত ও জাগ্রত করে। তিনি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা আজও পূর্ণ কার্যকারিতার সাথে চলছে।
● স্বামী বিবেকানন্দ:(পরিচয়).
• জন্ম: ১২ জানুয়ারী, ১৮৬৩।
• জন্মস্থান: কলকাতা, ভারত।
• ছোটবেলার নাম: নরেন্দ্র নাথ দত্ত (বিলে)।
• পিতা: বিশ্বনাথ দত্ত।
• মাতা: ভুবনেশ্বরী দেবী।
• শিক্ষা: কলকাতা মেট্রোপলিটন স্কুল; প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা।
• ধর্ম: হিন্দু ধর্ম।
• গুরু: রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব।
• রামকৃষ্ণ মিশন: (১৮৯৭), রামকৃষ্ণ মঠ, নিউ ইয়র্কের বেদান্ত সোসাইটি।
• দর্শন: অদ্বৈত বেদান্ত।
• মৃত্যু: ৪ঠা জুলাই, ১৯০২।
• মৃত্যু স্থান: বেলুড় মঠ, বেলুড়, পশ্চিমবঙ্গ।
● স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের ইতিহাস:
• ১৮৬৩ সালের ১২ই জানুয়ারী কলকাতায় এক সচ্ছল বাঙালি পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
• তিনি ছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরী দেবীর পুত্র।
• তিনি পশ্চিমা বিশ্বের কাছে বেদান্ত ও যোগের ভারতীয় দর্শন উপস্থাপন করেছিলেন।
• তিনি আন্তঃধর্ম সচেতনতা বৃদ্ধি, ১৯ শতকের শেষের দিকে বিশ্ব মঞ্চে হিন্দুধর্ম প্রবর্তনের জন্য কৃতিত্বপ্রাপ্ত।
• ১৮৯৭ সালে, তিনি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর গুরু স্বামী রামকৃষ্ণ পরমহংসের নামে এই মিশনের নামকরণ করেছিলেন।
• তিনি শিকাগোতে (মার্কিন) প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন, ১৮৯৩ সালের প্রথম ধর্ম সংসদের সভায়।
● স্বামী বিবেকানন্দর দর্শন:
● নৈতিকতা:
• নৈতিকতা বিবেকানন্দের মতে আচরণবিধি ছাড়া আর কিছুই ছিল না যা একজন মানুষকে ভালো নাগরিক হতে উৎসাহিত করে।
• তিনি আত্মার অন্তর্নিহিত বিশুদ্ধতা এবং ঐক্যের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একটি নতুন নৈতিক তত্ত্ব এবং একটি নতুন নৈতিক নীতি দিয়েছেন।
• তিনি মানুষকে শুদ্ধ হতে নির্দেশ দেন কারণ আমাদের আসল সারমর্ম হল বিশুদ্ধতা, আমাদের সত্যিকারের ঐশ্বরিক আত্মা বা আত্মা।
• প্রতিবেশীদের ভালোবাসা ও সেবা করারও আহ্বান জানান তিনি। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন যে আমরা সকলেই পরমাত্মা নামে পরিচিত পরম আত্মায় এক।
● ধর্ম:
• আধুনিক বিশ্বে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদানগুলির মধ্যে একটি হল ধর্মকে একটি সর্বজনীন অভিজ্ঞতা, যা সমস্ত মানবজাতির জন্য সাধারণ, অতীন্দ্রিয় সত্যের রূপে বোঝা।
• তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রতিটি ধর্মই আমাদেরকে চিরন্তন সর্বোচ্চ - স্বাধীনতা, জ্ঞান, সুখের দিকে পরিচালিত করেছে।
• এটি পরমাত্মার অংশ হিসাবে একজনের আত্ম উপলব্ধি করে করা যেতে পারে।
● শিক্ষা:
• তিনি আমাদের মাতৃভূমির পুনরুদ্ধারের জন্য শিক্ষার উপর ব্যাপক জোর দেন।
• তার মতে একটি দেশ সেই অনুপাতে উন্নত হয় কারণ জ্ঞান জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
• তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি এমন হওয়া উচিত যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের স্বাভাবিক জ্ঞান ও শক্তি প্রদর্শন করতে পারে।
• তিনি বলেন যে শিক্ষা শিক্ষার্থীদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলবে এবং জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়তা করবে।
• তিনি মানব-সৃষ্টির জন্য একটি চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষা প্রচার করেন।
● যৌক্তিকতা:
• তিনি আধুনিক বিজ্ঞানের পদ্ধতি এবং অনুসন্ধানের সাথে সম্পূর্ণ একমত ছিলেন।
• তিনি সর্বদা ভারতীয় জনগণকে জাতিভেদ প্রথা দূর করতে এবং বিজ্ঞান ও শিল্পায়নকে উৎসাহিত করার আহ্বান জানান।
• তিনি ভারতে বর্ণপ্রথার অনমনীয়তার নিন্দা করেছিলেন।
• তিনি ভারতীয় সমাজে বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বাজে আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন।
● স্বামী বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদ:
ভারতবর্ষ যখন পরাধীনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখন যাঁরা জাতীয়তাবাদের প্রচার করে দেশবাসীকে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি হতদরিদ্র, নির্যাতিত ভারতবাসীকে মানবপ্রেম ও স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করে তাদের নতুন শক্তিতে জাগিয়ে তোলেন।
● আত্মবিশ্বাস: স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবাসীকে পরাধীনতার গ্লানি দূর করে আত্মবিশ্বাসী হতে বলেন। তিনি ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে দেশবাসীকে বলেন, “ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী; বল ভাই— ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।”
● স্বদেশের সংস্কৃতির প্রতি আস্থা: বিবেকানন্দ তাঁর ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের নিন্দা করেন এবং ভারতবাসীকে নিজ সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি আস্থাবান হতে বলেন।
● ভারতমাতার বন্দনা: বিবেকানন্দ ভারতবাসীকে বলেন যে, মানুষ জন্ম থেকেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। এখানে মা বলতে তিনি দেশমাতাকে বুঝিয়েছেন। তিনি ভারতবাসীকে বলেন যে, অন্যান্য দেবদেবী বাদ দিয়ে আগামী ৫০ বছর ভারতমাতাই যেন সবার একমাত্র আরাধ্য দেবী হন। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন, “যে দেশপ্রেম বঙ্কিমচন্দ্রে ছিল কবিকল্পনা, বিবেকানন্দের রচনায় তা একটি অবয়ব নিল।”
● শিকাগো বক্তৃতা: বিবেকানন্দ ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরে আয়োজিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে উপস্থিত থেকে সেখানে ভারতের অদ্বৈত বেদান্তের কথা বিশ্ববাসীকে শোনান এবং বিশ্ববাসী ভারতের উদার ধর্মীয় ঐতিহ্যের কথা শুনে মুগ্ধ হয়। এতে ভারতীয় ঐতিহ্যের মর্যাদা বাড়ে।
● মানবধর্ম প্রচার: বিবেকানন্দ জাতিগঠনের উদ্দেশ্যে মানবধর্মের কথা বলেন। তাঁর ধর্ম হল ‘মানুষ তৈরির ধর্ম’। এই মানুষ তৈরির উদ্দেশ্যেই তিনি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে রামকৃয় মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।
● নতুন ভারতের স্বপ্ন: বিবেকানন্দ ভারতের সাধারণ শ্রমজীবী ও তথাকথিত নীচজাতির উন্নতির মাধ্যমে এক নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাই তিনি বলেন, “নূতন ভারত বেরুক, বেরুক লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে-মালা-মুচি-মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে, বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে, বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, বেরুক ঝোপ - জঙ্গল পাহাড় - পর্বত থেকে।”
● ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বপ্ন: বিবেকানন্দ ভারতবাসীকে জাতিভেদ ত্যাগ করে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নতির জন্য কাজ করতে বলেন। তিনি বলেন যে, অতীতের বিভিন্ন যুগে ভারতে শূদ্ররা নিপীড়িত হয়েছে। কালের চক্রেই একদিন শূদ্ররা ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। তাই বিভেদ নয়, একতাই ভারতের উন্নতির একমাত্র পথ।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে স্বামী বিবেকানন্দের অসামান্য ভূমিকার কথা স্মরণ করে ঐতিহাসিক আর জি প্রধান তাঁকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক' বলে অভিহিত করেছেন। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ বলেছেন, “বিবেকানন্দই আমাদের জাতীয় জীবন গঠনকর্তা। তিনিই ইহার প্রধান নেতা।”
● যৌবন:
• তিনি বিশ্বাস করতেন, আমাদের তরুণ-তরুণীরা যদি দৃঢ়চেতা হয়, তাহলে পৃথিবীতে আমাদের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব বলে কিছু নেই।
• তিনি তার শিক্ষা, পাঠ এবং বই দিয়ে দেশের অনেক যুবককে অনুপ্রাণিত করেছেন।
• তার জন্মদিন ১২ জানুয়ারী জাতীয় যুব দিবস হিসাবে পালিত হয় এবং সেই দিন থেকে শুরু হওয়া সপ্তাহটি জাতীয় যুব সপ্তাহ হিসাবে পরিচিত।
• তার অনেক উদ্ধৃতির মধ্যে একটি বলে, "একজন মানুষ রুপি ছাড়া দরিদ্র হয় না, কিন্তু স্বপ্ন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাড়া একজন মানুষ সত্যিই দরিদ্র।"
● বেদান্ত:
- বেদান্ত উপনিষদ এবং তাদের ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে ছিল।
- এর উদ্দেশ্য ছিল 'ব্রাহ্মণ' (চূড়ান্ত বাস্তবতা) সম্পর্কে অনুসন্ধান করা যা ছিল উপনিষদের কেন্দ্রীয় ধারণা।
- এটি বেদকে তথ্যের চূড়ান্ত উৎস হিসাবে দেখেছিল এবং যার কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা যায় না।
- এটি ত্যাগের (কর্ম) বিপরীতে জ্ঞানের (জ্ঞান) পথের উপর জোর দিয়েছে।
- জ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল 'মোক্ষ' অর্থাৎ 'সংসার' থেকে মুক্তি।
1 মন্তব্যসমূহ
দারুণ ভাবে যৌক্তিক ও বাস্তববাদী ভাবনা
উত্তরমুছুন