সামাজিক চুক্তি মতবাদ: (Social contract).

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মতবাদ হল সামাজিক চুক্তি মতবাদ। এই তত্ত্বের প্রধান বক্তারা হলেন ব্রিটিশ চিন্তাবিদ টমাস হবস, জন লক এবং ফরাসি দার্শনিক রুশো। রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ে সকল মতবাদ এর মধ্যে সামাজিক চুক্তি মতবাদ বিশেষ প্রয়োজনীয়তা লাভ করেছে।




সামাজিক চুক্তির মূল বক্তব্য:
এক সময় মানুষ যখন রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন ছিলনা, তখন সে প্রাকৃতিক অবস্থা বাস করত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগন এই প্রাকৃতিক অবস্থা কে, প্রাক সামাজিক আবার কেউ কেউ এই অবস্থাকে প্রাক রাষ্ট্রীয় বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই অবস্থায় মানুষের জীবন প্রাকৃতিক আইনের দ্বারা পরিচালিত হতো। এই প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের কোন অধিকার ছিল না। কালক্রমে এই পরিবেশ অসহনীয় হয়ে উঠলে মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত করল। এই চুক্তির ফলে সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের।


হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদ:
টমাস হবস তাঁর “লোভিয়াথান” গ্রন্থে বলেছেন যে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবন ছিল নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, ঘৃণ্য, পাশবিক ও স্বল্প স্থায়ী। এই অবস্থায় কোনো আইন-কানুন ছিলনা। “জোর যার মুল্লুক তার” নীতি ছিল তাদের মন্ত্র। আদিম মানুষ প্রাকৃতিক রাজত্বের অনিশ্চিয়তা এবং অস্থিতিশীলতা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে সমস্ত ক্ষমতা একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তির সংসদের হাতে অর্পণ করে। এই ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদ হলেন সার্বভৌম শক্তির কেন্দ্রস্থল এইভাবে সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের।


জন লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদ:
জন লক তাঁর "Two Treatises On Civil Goverment” গ্রন্থে বলেছেন, প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল শান্তি, শুভেচ্ছা ও পারস্পরিক সহযোগিতার রাজ্য। মানুষের জীবন স্বাভাবিক আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু সেই সময় মানুষ কিছু অসুবিধা সম্মুখীন হয়।

১. স্বাভাবিক আইনের কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ছিল না।

২. এই আইনকে ব্যাখ্যা করার কোন সংস্থা ছিল না।

৩. এই আইনকে বলবৎ করার মতো কোনো কর্তৃপক্ষ ছিলনা। এইসকল সমস্যাকে দূর করার জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে যুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে।


রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদ:
রুশো তাঁর "Social Contract” গ্রন্থে প্রাকৃতিক অবস্থাকে মর্তের স্বর্গ রূপে অভিহিত করেছেন। তার মতে সেই সময় মানুষ সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে সহজ সুন্দর জীবন যাপন করত। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে মানুষে মানুষে আর্থিক ভেদাভেদ দেখা দিল। হিংসা-দ্বেষ হত্যা যুদ্ধ সমাজের স্বাভাবিক হয়ে উঠল। এই অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য মানুষ নিজের মধ্যে চুক্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করলো। এই চুক্তির ধারা সর্বভৌম ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। "সাধারণ ইচ্ছার হাতে।

সমালোচনা:
১. পৃথিবীর কোন দেশের ইতিহাসে এরূপ উদাহরণ নেই। যে আদিম মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য পরস্পরের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছে।

২. প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের রাষ্ট্র সম্পর্কে যদি কোন ধারনা না থাকতো তাহলে রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে শৃঙ্খলা আসবে এই রাজনৈতিক ধারণা তাদের মধ্যে আসতো না।

৩. প্রাকৃতিক অবস্থায় যে স্বাধীনতা ও অধিকারের কল্পনা করা হয়েছে তা স্বীকার করা যায় না। কারণ রাষ্ট্রীয় আইন এবং সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা বা অধিকার সম্ভব হয় না।

৪. চুক্তির অর্থ হল আইন সঙ্গতভাবে পারস্পরিক বোঝাপড়া বা অঙ্গীকার। আইনের দ্বারাই চুক্তি সার্থক হতে পারে। কিন্তু প্রাকৃতিক অবস্থা কোন আইন ছিল না।

৫. চুক্তির ফলে যদি রাষ্ট্র গঠিত হয় তাহলে যারা চুক্তির সঙ্গে জড়িত কেবল তারাই চুক্তির শর্তাবলী মানতে বাধ্য। পরবর্তী প্রজন্ম তা মেনে নিতে বাধ্য নয়।

     পরিশেষে বলা যায় যে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ব্যাখ্যা হিসেবে সামাজিক চুক্তি মতবাদ কে গ্রহণ করা যায় না। এই মতবাদকে মানুষের কল্পনাপ্রসূত একটি মতবাদ বলা যেতে পারে।

0 মন্তব্যসমূহ