গান্ধীর অছিতন্ত্র: (Gandhi's Trusteeship Theory).

অহিংস সমাজ গঠনের জন্য গান্ধী যে তিনটি নীতি কে ব্যক্তিজীবনে ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন তার মধ্যে "অছিতন্ত্র" বা "ট্রাস্টিশিপ' অন্যতম। বাকি দুটি নীতি হলো বর্ণ ব্যবস্থা এবং বিকেন্দ্রীকরণ


● আইনগতভাবে অছি বা ট্রাস্টি বলতে বোঝায় সম্পত্তির তত্বাবধায়ক বা সম্পত্তির পরিচালক।

দীর্ঘদিনের জন্য কেউ বিদেশযাত্রা করলে তার সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অথবা নাবালকের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আইনসম্মত নিয়োগ পত্রের মাধ্যমে বিশ্বাস ভাজন কোন ব্যক্তিকে সেই সম্পত্তির নিয়োগ করা হয়।

অছি বা ট্রাস্টি তার দায়িত্ব পালনের জন্য মিতব্যয়ীর মত ওই সম্পত্তি থেকে যৎসামান্য গ্রহণ করেন এবং বাকি সমস্ত অংশ মালিকের জন্য রক্ষণাবেক্ষণ করেন।

সম্পত্তির মালিক বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করলে অথবা নাবালক সাবালক হলে অছি বা ট্রাস্টি তার সমুদয় সম্পত্তি তাদের প্রত্যার্পন করেন। এটাই হলো আইনসম্মত।

গান্ধীজী স্বাধীন ভারতের সম্পত্তির মালিকদের যথা রাজা, জমিদার, পুঁজিপতিদের অছির বা ট্রাস্টের ভূমিকা পালন করতে বলেছেন।

গান্ধীজীর মতে স্বাধীন ভারতে সাম্যবাদ অনুসরণ করে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা বিলোপ সাধন নিষ্প্রয়োজন, তবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলেও যা একান্ত প্রয়োজনীয়তা হল রাজা জমিদার পুঁজিপতি এরা প্রত্যেকেই নিজেকে সম্পত্তির বা ট্রাস্টি রূপে গণ্য করবেন।


গান্ধীজীর অছিতন্ত্রর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে না পেরে তৎকালে অনেকে বিরূপ সমালোচনা করে বলেছেন। তাদের মতে, অছিতন্ত্র বা ট্রাস্টিশিপ এর মাধ্যমে গান্ধীজী জনসাধারণের স্বার্থকে সুরক্ষিত না করে রাজা জমিদার, পুঁজিপতি প্রভৃতি কায়েমি স্বার্থপর ব্যাক্তিদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে চেয়েছেন।

গান্ধীজীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। গান্ধীজীর অছিতন্ত্র সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধি করলে এটা স্পষ্ট হয় যে ওই ব্যবস্থার মাধ্যমে গান্ধীজী প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা কে বিলোপ করার পথ নির্দেশ দিয়েছেন।

সত্যশোধক ভারতীয় ঋষির মহাবাক- “তোমার ভোগ হোক ত্যাগের মাধ্যমে" গান্ধীজীর অছিতন্ত্রের ভিত্তিভূমি ভারতীয় বেদ উপনিষদ এর ধ্যান - ধারণাকে অনুসরণ করে গান্ধীজী তার তার অছিতন্ত্রে ভোগের পথ ও পাথেয় বলেছেন।

গান্ধীজী তার জীবন সত্য দিয়ে এটা উপলব্ধি করেছেন যে আইন করে বা বাইরের অনুশাসন চাপিয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা বিলোপ সাধন সম্ভব নয়, তার জন্য চাই ত্যাগের মাধ্যমে ভোগের বাসনা, অপরিগ্রহ, সাম্যবাদ ইত্যাদি।

গীতায় উক্ত ভাবধারা উদ্ভূত হওয়া সহজ কথায় আসক্তির কলুষ থেকে মনকে মুক্ত করে হৃদয় পরিবর্তন করা।

গান্ধীজীর অছিতন্ত্রে এ কথায় বলা হয়েছে যে কোন মানুষই কোনো সম্পত্তির মালিক নয়, মানুষের আবির্ভাব কালে সে কোন সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে আবির্ভূত হয় নি সম্পত্তির মালিকানা কৃত্রিম, মানুষের সৃষ্টি। জগতের সবকিছুর স্থাবর - অস্থাবর, চেতন - অচেতন, সূক্ষ্ম - স্থূল, দৃষ্ট - অদৃষ্ট, জগতের সবকিছুর আসল মালিক ভগবা মানুষ নয়। মানুষ কেবল ওই সম্পত্তির ট্রাস্টি মাত্র।

আইনানুগ অতিন্ত্রের সঙ্গে গান্ধীজী তার উচিত নীতি ও ধর্মের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। জগতের সমুদয় মালিকানা ভগবানের বা ঈশ্বরের। প্রজার মালিক রাজা নয়, জমির মালিক জমিদার নয়, কল কারখানার মালিক শিল্পপতি নয়, এমনকি মানুষের বল বীর্যের, কলা কৌশল এর মালিক মানুষ নয়। সবকিছুর মালিক হলেন ভগবান। রাজা ভূমধ্যকারি, পুঁজিপতি এমনকি প্রত্যেকটি মানুষ ভগবানের ওই সম্পত্তির আছি বা ট্রাস্টি মাত্র।

সমাজকল্যাণে ব্রতী হয়ে প্রত্যেক মানুষ ঈশ্বরের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। কাজেই গান্ধীজীর অছিতন্ত্রের তাৎপর্য হলো প্রত্যেক মানুষ রাজা - প্রজা, শিল্পপতি - শ্রমিক নির্বিশেষে সমাজের প্রত্যেক মানুষ নিজেকে ভগবানের অছি বা তত্ত্বাবধায়ক রূপে গণ্য করে তার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন এবং ওই সম্পত্তির যৎসামান্য নিজের জন্য ব্যয় করে বাকি সব অংশ অপরের ভোগের জন্য ত্যাগ করবেন অর্থাৎ অবশিষ্ট সবটাই সমাজসেবায় সমর্পণ করবেন।

উল্লেখযোগ্য যে, গান্ধীজি অতিন্ত্র বা ট্রাস্টিশিপ নীতিকে স্থায়ী ব্যবস্থা রূপে গণ্য না করে আপৎকালীন সাময়িক ব্যবস্থারূপে গণ্য করতে বলেছেন। স্বাধীনতার অবব্যবহৃত পরবর্তীকালে যাতে সম্পদকে কেন্দ্র করে বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে নিরন্তর কলহ সমাজের শান্তি - শৃঙ্খলা কে ব্যাহত না করে, এই উদ্দেশ্যেই তিনি আপৎকালীন ব্যবস্থা রূপে ও চিত্রের উল্লেখ করেছেন।

অছিতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় পরিবর্তন ঘটলে, বিস্তৃত হলে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তখন আর অছি ব্যবস্থা আছিতন্ত্রের ব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন থাকবে না।




গান্ধীর অছিতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য:
গান্ধীজী সম্মত অছিতন্ত্রের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য গুলি উল্লেখ করা হল:-

প্রথমতঃ অছিতন্ত্রে অর্থনৈতিক সাম্য কে লক্ষ্য বস্তু রূপে গণ্য করা হয়। অছি গিরি ব্যবস্থায় এটাই দেখা হয় যাতে কোনো ব্যক্তির উপার্জন ও সম্পদ তার তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত না হয়।

দ্বিতীয়তঃ এই ব্যবস্থায় প্রতিভা ও সামর্থ্য কে উপেক্ষা করা যায় না। সমাজ সেবায় নিয়োজিত মেধাবী ও কৌশলীরা যে কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা লাভ করতে পারে ট্রাস্টিশিপ এ তা অনুমোদন করা হয়।

তৃতীয়তঃ অদ্বিতন্ত্র সম্পত্তির জাতীয়করণের অথবা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবলুপ্তির বিরুদ্ধাচারণ করে মানুষের হৃদয়ের পরিবর্তন সাধনাকে কাম্য বস্তু রূপে গণ্য করে।

চতুর্থতঃ অছিতন্ত্র উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি লাভের বিরোধিতা করে অনুসারে ব্যবস্থা স্থায়ী - অস্থায়ী কোন সম্পত্তি জমিদার শিল্পপতি প্রভৃতি যদি না হয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ নিজের সুখের জন্য ব্যয় করে অধিকারীদের মধ্যে উপযুক্ত সম্পদ রান্না করে তাহলে জনমত সৃষ্টি করে সিওসি কে পদচ্যুত করা চলে কাজেই জমিদারের সন্তান জমিদারি অথবা শিল্পপতির সন্তান শিল্প সংস্থার অধীনে যুক্ত নাও হতে পারে।

0 মন্তব্যসমূহ