ভারত ছাড়ো আন্দোলন, বা আগস্ট আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের দাবিতে ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক সর্ব-ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির বোম্বে অধিবেশনে শুরু করা একটি আন্দোলন। ভারত ছাড়ো আন্দোলন ৮ আগস্ট পালন করা হয় যা আগস্ট ক্রান্তি নামেও পরিচিত। এটি স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হিসাবে বিবেচিত হয় যেখানে জনগণও অংশগ্রহণ করে এবং নিজেই দায়িত্ব গ্রহণ করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা:
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধী দ্বারা শুরু হয়েছিল কিন্তু গান্ধী যাকে ভারত থেকে "একটি সুশৃঙ্খল ব্রিটিশ প্রত্যাহার" বলে দাবি করেছিল তা দাবি করে অল-ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির প্রতিবাদ করেছিল। এটি ব্রিটিশদের অবিলম্বে কাজ করতে বাধ্য করে এবং শীঘ্রই গান্ধীর বক্তৃতার কয়েক ঘন্টার মধ্যে সমস্ত সিনিয়র INC নেতাদের বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করা হয়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ:
বিশ্বে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ভারতের অভ্যান্তরিন জটিলতা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে জাপানের সেনাবাহিনী বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন দখল করে নেয়। ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেস উভয় ভারতে জাপানি আক্রমণের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস কখনো চাননি ভারতবর্ষ একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হোক। এই চিন্তা করে গান্ধিজী এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রেরিত প্রস্তাবে ইংরেজদের দেশ ছেড়ে যেতে বলেন। শুরু হয় কংগ্রেসের ভারত ছাড়ো আন্দোলন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
• মহাত্মা গান্ধী, আবদুল কালাম আজাদ, জওহরলাল নেহেরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মতো বেশ কিছু জাতীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
• কংগ্রেসকে একটি বেআইনি সমিতি ঘোষণা করা হয়, নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং সারা দেশে এর অফিসে অভিযান চালানো হয় এবং তাদের তহবিল হিমায়িত করা হয়।
• বিক্ষোভ ও মিছিলের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের প্রথমার্ধ শান্তিপূর্ণ ছিল। মহাত্মা গান্ধীর মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলছিল।
• আন্দোলনের দ্বিতীয়ার্ধে ডাকঘর, সরকারি ভবন ও রেলস্টেশনে অভিযান ও আগুন লাগিয়ে সহিংস ছিল। লর্ড লিনলিথগো সহিংসতার নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
ভাইসরয়ের কাউন্সিল অফ মুসলিম, কমিউনিস্ট পার্টি এবং আমেরিকানরা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের তাৎপর্য:
• মহাত্মা গান্ধী বা অন্য কোন নেতার নেতৃত্ব ছাড়াই আন্দোলনটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যাঁদের সকলেই এর শুরুতে জেলে বন্দী হয়েছিলেন।
• এতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বিপুল সংখ্যক অংশগ্রহণ করেন।
• বিকেন্দ্রীভূত কমান্ড ছিল এই আন্দোলনের প্রধান তাৎপর্য।
• জনসাধারণের মধ্যে উত্থান-পতন দেখে ব্রিটিশরা ভারতের স্বাধীনতার বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সাথে ভাবতে শুরু করে। এটি ১৯৪০ এর দশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে রাজনৈতিক আলোচনার প্রকৃতি পরিবর্তন করে যা শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে।
• 'ডু অর ডাই' স্লোগানটি আজ পর্যন্ত সবচেয়ে ক্রান্তিকারি স্লোগান হিসেবে রয়ে গেছে।
• এটি রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীকও বটে। মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) এমনকি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি গান্ধীর বিরোধিতা করেছিল এবং সেই সাথে তার সম্পূর্ণ আইন অমান্য করার আহ্বান জানায়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা:
ভারত ছাড়ো আন্দোলন এগিয়ে নিতে নারীদের ভূমিকা অসামান্য। সুচেতা কৃপালনী, অরুনা আসফ আলি এ আন্দোলনের বৈপ্লবিক কাজকর্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। কংগ্রেসের এই সংকটময় সময়ে উষা মেহতা গোপনে জাতীয় কংগ্রেসের বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করতেন। এসময় মহিলা স্বেচ্ছাসেবী দ্বারা গঠিত হয় ভগিনী সেনা। ভাগিনী সেনার সদস্যরা খুবই বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রদর্শন করেছিলেন। পাঞ্জাবের গৃহবধূ ভোগেশ্বরী ফুকননী, আসামের ১৪ বছরের কিশোরী কনকলতা বড়ুয়া প্রমুখ বিরঙ্গনা মহিলার নাম ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। গান্ধী বুড়ি নামে খ্যাত মাতঙ্গিনী হাজরা ১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তমলুক থানা দখল করার নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। বীরভূমের শান্তিনিকেতন অঞ্চলে এই আন্দোলনকে সংগঠিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন সুনিতা সেন, নন্দীতা কৃপালনী, এলা দত্ত, লাবণ্যপ্রভা দত্ত, মায়া ঘোষ প্রমুখ বিরাঙ্গনা নারী।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মাতঙ্গিনী হাজরা ভূমিকা:
১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তমলুক থানা দখল করার নেতৃত্বে ছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালাতে থাকলে তিনি অন্যান্য সহকর্মীদের পিছনে রেখে নিজেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। পুলিশ তিনবার তাঁকে গুলি করলে তাঁর কপালে ও দুই হাতে লাগে। তবুও এই বিরাঙ্গনা সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন এবং শেষে মৃত্যুবরণ করেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ফলাফল:
• এই আন্দোলনের ফলে উত্তরপ্রদেশের বালিয়ায় একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
• বিহারের কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি পুলিশ কনস্টেবলরাও চাকরি ছেড়ে আন্দোলনে সামিল হয়।
• ব্রিটিশ সরকার নেতৃত্ব বিহীন ভারতবাসীর সংগ্রামে স্তম্ভিত হয়েছিল।
• ভারতবাসী আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এই আন্দোলনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলে।
0 মন্তব্যসমূহ