আকবরের রাজপুত নীতি: (Akbar's Rajput policy).

আকবরের রাজপুত নীতি:

যুদ্ধ দ্বারা রাজ্য বিস্তারের নীতি গ্রহণ করলেও আকবর ছিলেন বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি এবং একে দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করতে হলে এই দেশের অধিকাংশ প্রজা হিন্দুদের প্রতি, বিশেষত হিন্দু ক্ষাত্রশক্তি রাজপুতদের প্রতি সহনশীল নীতি অবলম্বন করে মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে তাঁদের সমর্থন লাভ করতে হবে। তাই দেখা যায়, আকবর যুদ্ধবিগ্রহে ও রাজ্যজয়ে আফগান ও রাজপুতগণের প্রতি দুই ভিন্ন নীতি অবলম্বন করেছিলেন। তিনি ভারতের আফগান শাসকদের প্রতি যে কঠোর নীতি অনুসরণ করেছিলেন রাজপুতদের প্রতি সেই পরিমাণে উদার নীতি অবলম্বন করেছিলেন। যদিও মেবারের রাণা প্রতাপসিংহ আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন নি, তথাপি তাঁর রাজধানী চিতোর দুর্গের পতনের পর (১৫৬৮ খ্রিঃ) একের পর এক রাজপুত শাসকগণ আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন রণথম্ভোর, কালিঞ্জর, বিকানীর, জয়সলমীর, জয়পুর, যোধপুর প্রভৃতি রাজ্যের রাজারা। তিনি এই রাজপুত রাজাদের রাজ্যচ্যুত না করে তাঁদের আনুগত্য লাভেই সন্তুষ্ট ছিলেন। শুধু তাই নয়, রাজপুতানার অধিকাংশ রাজপুত বংশের সঙ্গে তিনি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে এই বীর হিন্দু ক্ষত্রিয়গণকে আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ করেন। ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে আকবর জয়পুরের নৃপতি রাজা বিহারীমলের কন্যাকে বিবাহ করেন। এই বিবাহের ফলে আকবর বিহারীমলের পৌত্র রাজা মানসিংহের বন্ধুত্ব অর্জন করেন। আকবরের সেনাপতি হিসাবে মানসিংহের অবদান অবিস্মরণীয়। মেবারের সাথে দীর্ঘ সংগ্রামে রাজা মানসিংহ ও অন্যান্য রাজপুতগণ আকবরকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিকানীর ও জয়সলমীরেরও মুঘল সাম্রাজ্যের সংহতিসাধনে রাজকন্যাদের বিবাহ করেন ও ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে ভগবানদাসের কন্যার সঙ্গে নিজ পুত্র সেলিমের বিবাহ দেন। বহু রাজপুত বীরকে মুঘল সাম্রাজ্যে মনসবদার এবং অন্যান্য উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত করে আকবর শুধু রাজপুতদের প্রীতি ও শুভেচ্ছাই লাভ করেন নি, তিনি এই অসীম সাহসী হিন্দুগণকে মুঘল সাম্রাজ্যের এক সুদৃঢ় স্তম্ভে পরিণত করেন। রাজকার্যে ও শাসনব্যবস্থায় সর্বপ্রকার হিন্দু - মুসলমানের বিভেদ নীতি বর্জন করে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করেন।




আকবরের রাজপুত নীতির ফলাফল:
আকবর তাঁর রাজপুত নীতি কেবলমাত্র নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য গ্রহণ করেন নি। তিনি সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষার জন্য তিনি এই নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রাজপুত নীতির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

প্রথমত:- এই নীতিকে হিন্দু - মুসলমানের ভিতর সমতা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপানরূপে গণ্য করা যায়।

দ্বিতীয়ত:- তিনি সেনাপতিও কূটনীতিবিদের সক্রিয় সাহায্য লাভ করেছিলেন।

তৃতীয়ত:- সামরিক দিক থেকে হিন্দুদের নেতৃস্থানীয় রাজপুত ও মুঘলদের দীর্ঘকাল স্থায়ী মৈত্রী স্থাপিত হয়।

চতুর্থত:- এর ফলে ভারতবাসীর মনে ক্রমে এই ধারণা জন্মায় যে মুঘল বাদশাহরা বিদেশী শাসক নন, তাঁরা ভারতীয়। আকবরের পরে যে সব মুঘল বাদশাহ দিল্লীর সিংহাসনে বলেছিলেন তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের ধমনীতে রাজপুত রক্ত ছিল।

পঞ্চমত:- আকবরের রাজপুত নীতির ফলে মেবারের রাণা রাজপুতানায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

ষষ্ঠত:- এই নীতির ফল মুঘল এবং রাজপুত উভয়ের পক্ষেই লাভজনক হয়েছিল। এই নীতি রাজপুত নায়কদের নতুন মর্যাদা ও সর্বভারতীয় সম্মান লাভ করবার সুযোগ করে দেয়। সাধারণ রাজপুত সেনানীদের নতুন নতুন সামরিক অভিজ্ঞতা অর্জন করবার সুযোগ দেওয়ায় তারা বীরত্ব ও শৌর্য দেখাবার সুযোগ পায়। রাজপুত সৈন্যদের যোগদানের ফলে বাদশাহী সৈন্যবাহিনী পুষ্ট ও শক্তিশালী হয়। বিদেশ থেকে সৈন্যবাহিনীতে লোক সংগ্রহ করবার সমস্যা কিছুটা দূর হয়। মুঘল সৈন্যবাহিনীও জাতীয় সৈন্যবাহিনীতে পরিণত হয়।

সপ্তমত:- আকবরের রাজপুত নীতির ফলে ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসেও এক নবযুগের সূচনা হয়। মুঘলও রাজপুত নীতির সুষম সমন্বয়ে এক নতুন শিল্পরীতি গড়ে ওঠে। রাজপুত চিত্রশিল্পে ( Rajput Miniature Paintings ) এবং বিশেষভাবে দেখা যায়।

অষ্টমত:- আকবরের রাজপুত নীতির ফলে উত্তর ভারতের জনসাধারণ মুঘল শাসনব্যবস্থা বিনা দ্বিধায় স্বীকার করে নেয়। সবশেষে ধর্মীয় ক্ষেত্রে আকবরের এই নীতি বিশেষ ফলপ্রসূ হয়। যে সব কারণে আকবরের ধর্মমত উদার ও সহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল, তার অন্যতম কারণ হল আকবরের রাজপুত নীতি। ‘দীন - ই - ইলাহী’ ধর্মের ওপর এর প্রভাব দেখা যায়। আকবর হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কোনো পার্থকা করতেন না। তাঁর এই উদারনীতির ফলেই রাজপুতরা মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য দূর দূর অঞ্চলে গিয়ে নিজেদের দেহের রক্তে এই সাম্রাজ্যকে বাঁচাতে ইতস্তত করেনি। আকবরের আমল থেকে রাজপুতরা সাম্রাজ্যের এক বিরাট বড় অংশীদার হয় এবং এই ধারা ঔরংজেবের শাসনকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। জয়সিংহের কূটনীতির নিকট শিবাজী পরাজিত হয়েছিলেন এবং মুঘল দরবারে বন্দী অবস্থায় এসেছিলেন। রাজপুতদের আনুগতা পাবার ফলে সমগ্র হিন্দু জাতিই মুঘল শক্তিকে তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে। আকবরের রাজত্বকালে সামরিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে যে উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছিল তাতে রাজপুতদের অবদান অপরিসীম।

0 মন্তব্যসমূহ