গুপ্ত রাজা মহাসেনগুপ্তের অধীনে সামান্য একজন মহাসামন্ত হিসেবে শশাঙ্ক (নরেন্দ্রাদিত্য) জীবন শুরু করেন পরবর্তীকালে তিনি বঙ্গে গৌড় নামে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। শশাঙ্ককে বঙ্গদেশের প্রথম সার্বভৌম রাজা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই রাজার বংশ পরিচয় সম্পর্কে তেমন বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষ দিকে বাংলায় দুটি প্রধান অঞ্চল গড়ে ওঠে। এগুলো হল সমতট এবং গৌড়। পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা নিয়ে গঠিত ছিল সমতট। গৌড় বলতে বোঝানো হত উত্তর বাংলা ও পশ্চিম বাংলার উত্তর অংশ। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর পরবর্তী গুপ্ত বংশের রাজাগণ গৌড়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। গুপ্ত রাজা বৈন্যগুপ্তের মৃত্যুর পর থেকে কনৌজের মৌখরীরাজাদের সঙ্গে পরবর্তী গুপ্ত রাজাদের ক্রমাগত যুদ্ধ চলে। এছাড়া চালুক্য রাজাদের বার বার আক্রমণে গুপ্ত রাজারা দূর্বল হয়ে পড়ে। ফলে গৌড়ের ওপর গুপ্ত রাজাদের ক্ষমতা শিথিল হয়ে যায়। এই সুযোগে মহাসেনগুপ্তের কোন এক সামন্ত শশাঙ্ক গৌড়ের ক্ষমতা দখল করে ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
শশাঙ্কের পরিচয়:
শশাঙ্কের বংশ পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। শশাঙ্কের বেশ কিছু মুদ্রায় নরেন্দ্রগুপ্ত বা নরেন্দ্রাদিত্য নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই থেকে অনেকে মনে করেন, তিনি গুপ্ত বংশীয় শাসক ছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন তিনি গৌড়ের পূর্ববর্তী রাজা জয়নাগের বংশধর। তবে বেশিরভাগ ঐতিহাসিক তাঁকে মহাসেনগুপ্তের কোন এক সামন্ত বলে মনে করেন। ধর্মীয় দিক থেকে তিনি ছিলেন শিবের উপাসক।
শশাঙ্কের রাজ্যবিস্তার:
শশাঙ্কের রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ।
সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি রাজ্য বিস্তারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি দণ্ডভুক্তি (মেদিনীপুর), উৎকল (উড়িষ্যা), ও চিল্কা হ্রদ বা গঞ্জাম জেলা জয়লাভ করেন। তিনি নাকি মগধ ও স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য আগেই অধিকার করেন। পূর্ব ভারতের পর শশাঙ্ক পশ্চিম ভারত বিজয়ে উদ্যোগী হন। পশ্চিমে কনৌজের মৌখরীরাজারা ছিল গৌড়ের শত্রু। অন্যদিকে মৌখরীরাজ গ্রহবর্মনের সাথে থানেশ্বরের রাজা প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীর বিবাহ ঘটলে দুই রাজ্যের মধ্যে মৈত্রী স্থাপিত হয়। এই দুই শক্তিশালী রাজ্যের ঐক্যবদ্ধ হওয়া মালবরাজ দেবগুপ্তের পক্ষে অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল। এর প্রধান কারণ থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশের সাথে মালব রাজবংশের পুরুষানুক্রমিক শত্রুতা ছিল। এই অবস্থায় থানেশ্বরের শত্রু মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে মৈত্রী - জোট গঠন করেন। অপরদিকে কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মা শশাঙ্কের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে ভীত হয়ে পড়েন এবং নিজের রাজ্যের সুরক্ষার জন্য থানেশ্বর - কনৌজ শক্তি জোটের সাথে যোগ দেন। ইতিমধ্যে থানেশ্বররাজ প্রভাকরবর্ধনের হঠাৎ করে মৃত্যু ঘটলে মালবরাজ দেবগুপ্ত কনৌজ আক্রমণ করে রাজা গ্রহবর্মাকে পরাজিত করে হত্যা করেন এবং গ্রহবর্মার রাণী রাজ্যশ্রী বন্দিনী হন। অন্যদিকে শশাঙ্ক বারাণসী দখল করে কনৌজের দিকে অগ্রসর হন দেবগুপ্তকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু ,শশাঙ্কের যোগ দেওয়ার আগে মালবরাজ দেবগুপ্ত থানেশ্বরের রাজা প্রভাকরবর্ধনের পুত্র রাজ্যবর্ধনের কাছে পরাজিত হন ও নিহত হন। তবে রাজ্যবর্ধন শেষপর্যন্ত শশাঙ্কের হাতে নিহত হন।
শশাঙ্ক ও হর্ষবর্ধনের মধ্যে বিরোধ:
রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর তাঁর ছোট ভাই হর্ষবর্ধন থানেশ্বরের সিংহাসনে বসেন এবং নিজ ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করতে এবং শশাঙ্ককে শাস্তি দিতে যুদ্ধযাত্রা করেন। এই সময় কামরূপ রাজ্যের সঙ্গে থানেশ্বরের মধ্যে শক্তিজোট গড়ে ওঠে। শশাঙ্ক এই শক্তিজোটর ভয়ে ভীত হয়ে কনৌজ ত্যাগ করে নিজ রাজ্য ফিরে যান। হর্ষবর্ধন রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করে কনৌজ অধিকার করেন।
শশাঙ্কের কৃতিত্ব:
ইতিহাসে শশাঙ্কের কৃতিত্ব কখনো অস্বীকার করা যায় না। একজন সামন্ত হয়ে গৌড়ের সিংহাসন দখল করে গুপ্তদের হাত থেকে গৌড়কে মুক্ত করেন। হর্ষবর্ধনের মতো শক্তিশালী রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলা, বিহার, ও উড়িষ্যায় আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন। শশাঙ্কের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তী সময়ে পাল রাজারা বাংলাকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্য গঠনে প্রয়াসী হয়েছিলেন।
0 মন্তব্যসমূহ