১৯৬০ সালে জনস্বার্থ মামলার বিষয়টি তৈরি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৮০ সালে ভারতে এই বিষয়টি প্রথমবার পেশ করেন বিচারক ভি আর কৃষ্ণ আইয়ার এবং পি এন ভগবতী। যদি সমাজের কোনো নিয়ম সমাজের সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে সেক্ষেত্রে সেই নিয়মের বিরুদ্ধে আদালতে জনস্বার্থ মামলা দাখিল করা যায়। গরিব, পরিবেশবিদ, জাতি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক একটি গোষ্ঠী হিসাবে জনস্বার্থ মামলা দাখিল করতে পারে।
ভারতে জনস্বার্থ মামলার প্রবর্তন ‘locus standi'- এর প্রচলিত নিয়ম শিথিল করার মাধ্যমে সহজতর হয়েছিল। জনস্বার্থ মামলার অধীনে কোনো উৎসাহী নাগরিক বা কোনো সামাজিক সংগঠন যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অধিকার প্রয়োগের জন্য আদালতে যেতে পারে, যারা তাদের দারিদ্র, সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণে আদালতে যাওয়ার সামর্থ থাকে না। সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া জনস্বার্থ মামলার সংজ্ঞায় বলা আছে- ‘জনস্বার্থ বা সাধারণের আগ্রহের জন্য জনসাধারণ বা সম্প্রদায়ের আইনি অধিকার বা দায়বদ্ধতা রক্ষা করার জন্য আদালতে আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে আইন প্রয়োগ করা।
● নিম্নলিখিত বিষয়গুলি হল জনস্বার্থ মামলার মূল উদ্দেশ্য:
i. আইনের শাসনের বিচার।
ii. সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশগুলিতে ন্যায়বিচার কার্যকরের ব্যবস্থা করা।
iii. মৌলিক অধিকারগুলির অর্থবহ উপলব্ধি।
ii. সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশগুলিতে ন্যায়বিচার কার্যকরের ব্যবস্থা করা।
iii. মৌলিক অধিকারগুলির অর্থবহ উপলব্ধি।
• জনস্বার্থ মামলার বৈশিষ্ট্য :
১. জনস্বার্থ মামলা হল আইনি সহায়তা প্রদানের কৌশলগত অস্ত্র যা দরিদ্র জনগণের কাছে ন্যায়বিচার পৌছতে সাহায্য করে।
২. জনস্বার্থ মামলা সাধারণ মামলার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন হয় এবং এই মামলায় একপক্ষ ক্ষতিপূরণের দাবি করে ও অন্যজন সেই ক্ষতিপূরণের বিরোধিতা করে।
৩. সাধারণ মামলার ক্ষেত্রে একজন নিজের অধিকারের জন্য অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে কিন্তু, জনস্বার্থ মামলা আদালতে পেশ করা হয় জনস্বার্থের সমর্থন ও প্রচারের উদ্দেশ্যে।
৪. জনস্বার্থ মামলার উদ্দেশ্য হল দরিদ্র, অজ্ঞ বা সামাজিক বা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা বৃহৎ সংখ্যক মানুষের সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার রক্ষা করা এবং যাতে তা লঙ্ঘিত না হয় সেই দিকে নজর রাখা।
৫. জনস্বার্থ মামলা হল সমাজের দুর্বল অংশগুলিতে প্রদত্ত সাংবিধানিক বা আইনি অধিকার, সুবিধা এবং সুযোগ - সুবিধা পালন এবং তাদের কাছে সামাজিক ন্যায়বিচার পৌঁছানোর জন্য আবেদনকারী, রাষ্ট্র বা সরকারী কর্তৃপক্ষ এবং আদালতের পক্ষ থেকে একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
৬. জনস্বার্থ মামলার মাধ্যমে জনসাধারণের আঘাত নিরসন, জনগণের দায়িত্ব পালন, সামাজিক, সম্মিলিত, বিচ্ছিন্ন অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্য পরিচালিত হয়।
৭. সাধারণ মামলার চেয়ে জনস্বার্থ মামলার ক্ষেত্রে আদালতের ভূমিকা সদর্থক হয়।
৮. জনস্বার্থ মামলায় বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সাধারণ মামলার ন্যায় পৃথক অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত হয় না।
কোন কোন ক্ষেত্রে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যায়:
১৯৯৮ সাল সুপ্রিম কোর্ট একটি নির্দেশিকা জারি করে কোন কোন বিষয়ের ওপর জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যায়, সেই তালিকা অনুযায়ী নিম্নলিখিত বিষয়গুলির ওপর জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যায়:
যে সমস্ত বিষয় জনস্বার্থ মামলা হিসাবে গণ্য হবে না:
● জনস্বার্থ মামলার নীতিমালা:
সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক নিম্নলিখিত জনস্বার্থ মামলার নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে :
• জনস্বার্থ মামলার অপব্যবহার রোধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনামা:
- চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের বিষয়।
- উপেক্ষিত শিশুদের ওপর।
- ন্যূনতম মজুরি থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করা এবং শ্রমিকদের শোষণ করা ও শ্রমিক আইন ভঙ্গ করা প্রভৃতি বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা করা যায়।
- থানায় হয়রানি করা, অকাল মুক্তি, ১৪ বছর পূর্ণ হবার পর থানা থেকে মুক্তি না দেওয়া, থানায় মৃত্যু, স্থানান্তরিতকরণ, দ্রুত ট্রায়াল এবং ব্যক্তিগত বন্ডে মুক্তির বিষয় জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যায়।
- পুলিশ কোনো মামলা নথিভুক্ত না করতে চাইলে সেই বিষয়ে।
- মহিলাদের ওপর নৃশংস বিশেষ করে পণের জন্য, এছাড়া বধূকে খুন করা, মহিলাদের ওপর ধর্ষণ, খুন ও অপহরণ বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যায়।
- গ্রামের নাগরিকদের ওপর গ্রামের অন্য বাসিন্দা এবং পুলিশের অত্যাচারের বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যায়।
- তফশিলি জাতি, উপজাতি এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যায়।
- দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ জনস্বার্থ মামলা দায়ের করতে পারে।
- পারিবারিক ভাতা বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যায়।
যে সমস্ত বিষয় জনস্বার্থ মামলা হিসাবে গণ্য হবে না:
- বাড়ির মালিক ও ভাড়াটের মধ্যে বিবাদ।
- পরিষেবা বিষয়, এছাড়া পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সংক্রান্ত বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা হিসাবে গণ্য হবে না।
- চিকিৎসা এবং শিক্ষা সংক্রান্ত কোনো সংস্থায় ভর্তির ক্ষেত্রে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যাবে না।
- রাজ্য, কেন্দ্র এবং স্থানীয় সংস্থার বিরুদ্ধে যে সমস্ত বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যায় তা ব্যতীত অন্য বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যাবে না।
- হাইকোর্ট বা অধীনস্থ আদালতে পরে থাকা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যাবে না।
● জনস্বার্থ মামলার নীতিমালা:
সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক নিম্নলিখিত জনস্বার্থ মামলার নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে :
- অসুবিধাজনিত কারণে যে সকল মানুষ আদালতে যেতে পারে না তাদের হয়ে যে কোনো উৎসাহী ব্যাক্তি সুপ্রিম কোর্টের ৩২ নং ধারা এবং হাইকোর্টের ২২৬ নং ধারায় জনস্বার্থ মামলা দায়ের করতে পারে। আদালত সেই সকল মানুষদের অধিকার রক্ষার জন্য সংবিধানগতভাবে বাধিত থাকে এবং রাষ্ট্রকে নির্দেশ প্রদান করতে পারে সেই সকল মানুষদের সাংবিধানিক অধিকারকে রক্ষা করতে।
- জনগণের গুরুত্ব, মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত বিষয় যখন চিঠির আকারে আদালতের কাছে আছে তখন আদালত এই চিঠিকেই জনস্বার্থ মামলা হিসেবে বিবেচিত করতে পারে এবং দ্রুত মামলার কাজ শুরু করতে পারে।
- যখন সমাজের বৃহৎ অংশের মানুষের ওপর অবিচার হয় তখন আদালত ১৪ ও ২১ নং ধারা প্রয়োগ করতে ইতস্তত বোধ না করে দ্রুত ট্রায়ালের নির্দেশ প্রদান করতে পারে।
- আদালত যদি মনে করে সমাজের অবহেলিত মানুষদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তাহলে আদালত স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্রকে নির্দেশ প্রদান করতে পারে।
- দুটি বিদ্যমান গোষ্ঠীর বিবাদের জন্য ব্যক্তিগত মামলাকে আদালত জনস্বার্থ মামলা হিসেবে বিবেচনা করবে না।
- কোন কোন ক্ষেত্রে আদালত কমিশন তৈরি করতে পারে জনস্বার্থ মামলা সংক্রান্ত বিষয়ের তদন্তের জন্য।
• জনস্বার্থ মামলার অপব্যবহার রোধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনামা:
আদালত সর্বদা সত্য জনস্বার্থ মামলার ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করে এবং যদি অপব্যবহার করা হয় তাহলে মামলা দায়ের করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তিরস্কার প্রদান করতে পারে।
জনস্বার্থ মামলার প্রক্রিয়া শুরু করার পূর্বে মামলার সত্যতা যাচাই করতে পারে আদালত।
আদালত যদি সন্তুষ্ট হয় যে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে তাকেই মামলার প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ প্রদান করতে পারে।
আদালত যদি মনে করে যে জনস্বার্থ মামলা সত্য সমাজের - বিরাট অংশের মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য দায়ের করা হয়েছে তবেই মামলার প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ প্রদান করতে পারে।
0 মন্তব্যসমূহ