বাংলার নবান্ন উৎসব: (New Rice Festival).

               বাংলার নবান্ন উৎসব              

উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি।নবান্ন ঋতু কেন্দ্রিক ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব। নবান্ন উৎসব বাঙালি জাতিকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে। নবান্ন উৎসব বাঙালির জনজীবনে অনাবিল আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধির বার্তা নিয়ে আসে। 

নবান্ন উৎসব ইংরেজীতে যাকে বলে 'New Rice Festival' নবান্ন মানে নতুন অন্ন। 'নবান্ন' শব্দের অর্থ 'নতুন অন্ন'। নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে এবং আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড় সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন। নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা নবান্নের অঙ্গ একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে 'কাকবলী'।

নবান্ন উৎসব উপলক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিশুরা ধানখেত থেকে ধান কেটে বাড়ি এলে তাদের বরণ করে নেওয়া হয়। গবেষকদের মতে কৃষি প্রথা চালু হবার পর থেকে নবান্ন উৎসব পালন হয়ে থাকে। তবে ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর এই উৎসব ধীরে ধীরে কদর হারাতে থাকে। 
নবান্ন উৎসব এর অন্যতম প্রথা হচ্ছে কাকবলি। একটি কলার ডোগায় নতুন চাল, কলা, নারকেল নাড়ু কাককে খাওয়াতে হয়। প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়।

এই উৎসবে নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা পায়েস, ক্ষীর-সহ নানা রকম খাবার। সুস্বাদু খাবারের গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। সোনালী ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালির বিশেষ অংশ নবান্ন ঘিরে অনেক কবি-সাহিত্যিকের লেখায় উঠে এসেছে প্রকৃতির চিত্র। অতীতে পৌষ সংক্রান্তির দিনও গৃহ দেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল।



             বাংলা সাহিত্যে নবান্ন    
বাংলার কবি-সাহিত্যিকরাও নতুন ফসল ঘরে ওঠার ঋতু হেমন্ত আর নবান্ন উৎসবকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা-গান। ষড়ঋতুর লীলাবৈচিত্রে কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলা অগ্রহায়ণ মাস তথা হেমন্ত ঋতু আসে নতুন ফসলের স্বাগত নিয়ে। কৃষককে উপহার দেয় সোনালী দিন। তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো সোনালী ধানের সম্ভার স্বগৌরবে বুকে ধারণ করে হেসে ওঠে বাংলা।
তাই বিপুল বিস্ময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গেয়ে ওঠেন-

‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।’ হাসি ফোটে কৃষকের মুখেও; মাঠ ভরা সোনালী ফসল নতুন স্বপ্ন জাগায় চোখে।

কবি সুকান্ত’র ভাষায় যেন-
‘নতুন ফসলের সুবর্ণ যুগ আসে।’ ‘এই হেমন্তে কাটা হবে ধান, আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান’।
নবান্নের বর্ণনা তিনি তাঁর ‘এই নবান্নে’ কবিতায় এভাবেই বর্ণনা দিয়েছেন। হেমন্ত ঋতুর দিন-রাতের অবিশ্রান্ত শ্রমে কৃষকের ঘরে ওঠে সোনার ধান। বাংলার গ্রাম-গঞ্জ মেতে ওঠে নবান্নের উৎসবে।

‘ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়া এল কি ধরণীর সওগাত? নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাৎ।’  জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় এভাবে নতুন আমন ধানের আঘ্রাণে অগ্রহায়ণকে মাৎ করে দেওয়ার কথা উচ্চারিত হয়েছে।

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন হেমন্তে মাঠ ভরা ফসলের সম্ভারে মুগ্ধ হয়ে বলেন-
‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি-কোটার গান।
ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়,
কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায়।'

0 মন্তব্যসমূহ