আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম মৌলিক ধারণা হলো জাতীয় স্বার্থ। সাধারণভাবে জাতীয় স্বার্থ হল 'যাবতীয় জাতীয় মূল্যবোধের সমষ্টি'। এক্ষেত্রে 'জাতীয়' বলতে জাতি এবং রাষ্ট্র উভয়কে বোঝানো হয়েছে।
কিন্তু জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেল জাতীয় স্বার্থের ধারণাটিকে অস্পষ্ট বলে চিহ্নিত করেছেন। জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেল বলেছেন জাতীয় স্বার্থ হলো জাতীয় মূল্যবোধের সমষ্টি।
প্লেটোর অভিমত অনুযায়ী দার্শনিক রাজা ও অভিভাবক শ্রেণীর মতানুসারে নগররাষ্ট্রের স্বার্থের সহায়ক সবকিছুই হল জাতীয় স্বার্থ।
কৌলোমবিষ উলফের মতানুসারে, জাতীয় স্বার্থ হলো জাতি–রাষ্ট্র সমূহের সমন্বয়।
মর্গেন থাউ বলেছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল সারবস্তু হলো জাতীয় স্বার্থ। তাঁর মতে, যেকোন দেশের কতকগুলি ন্যূনতম স্বার্থ থাকে।
যেমন-ভৌগলিক অখন্ডতা রক্ষা, প্রচলিত রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুরক্ষিত করা এবং তার সংস্কৃতিক সত্ত্বা বজায় রাখা এই সকল স্বার্থ পূরণই হলো পররাষ্ট্র নীতির লক্ষ্য।
সুতরাং জাতীয় স্বার্থ বলতে জাতির সেইসব ন্যূনতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহকে বোঝায়, যেগুলি পূরণের জন্য রাষ্ট্রসমূহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এইসব ন্যূনতম লক্ষ্যের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা জাতীয় উন্নয়ন ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
জাতীয় স্বার্থের শ্রেণি বিভাগ
জাতীয় স্বার্থের ধারণাটিকে বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে শ্রেণি বিভাগ করেছেন। এই জাতীয় স্বার্থগুলি হল -
মুখ্য জাতীয় স্বার্থ :– প্রত্যেক জাতি জাতীয় স্বার্থের যে বিষয়গুলি সংরক্ষণ করা আবশ্যিক কর্তব্য বলে মনে করে তাকে বলে মুখ্য জাতীয় স্বার্থ। প্রতিটি জাতিই তার মুখ্য জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য কঠোর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। মুখ্য জাতীয় স্বার্থের বিষয়গুলি হল – প্রাকৃতিক পরিচিতি, রাজনৈতিক পরিচিতি এবং সাংস্কৃতিক পরিচিতির সংরক্ষণ।
মধ্য পরিধিমূলক স্বার্থ :– জাতীয় স্বার্থের একটি বিষয় হল মধ্য পরিধিমূলক লক্ষ্য সাধন। জাতীয় স্বার্থের এই বিষয়ের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক সাহায্যপুষ্ট নিজের দেশের অর্থনৈতিক সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা ও দাবিসমূহের মীমাংসা।
মূল্যবোধমূলক স্বার্থ :– প্রত্যেকটি দেশ জাতীয় স্বার্থে একটি মূল্যবোধ গড়ে তুলতে আগ্রহী যেখানে আত্মহুতি দিতে প্রস্তুত থাকে। এরূপ জাতীয় স্বার্থ মূলত পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক আদর্শ হিসাবে কাজ করে।
গৌণ জাতীয় স্বার্থ :– যখন কোনো দেশ বা জাতি তার অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্গে জড়িত না হলেও রাষ্ট্র যেসব স্বার্থকে রক্ষা করা নিজের কর্তব্য বলে মনে করে তাকে গৌণ জাতীয় স্বার্থ বলে।
সাধারণ জাতীয় স্বার্থ :– সাধারণ জাতীয় স্বার্থ বলতে একটি রাষ্ট্রের সেই সব স্বার্থকে বোঝোয় যেগুলির অগ্রাধিকার রাষ্ট্র তার গুরুত্ব অনুযায়ী নির্ধারণ করে।
জাতীয় স্বার্থরক্ষার উপায়
জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কতকগুলি বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
কূটনীতি :- জাতীয় স্বার্থ রক্ষার অন্যতম প্রধান উপায় হলো কূটনীতি। প্রতিটি রাষ্ট্রের কূটনীতিবিদরা নিজেদের সরকারের বিদেশনীতিকে অন্য রাষ্ট্রের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য আলাপ-আলোচনা করে। কূটনীতিবিদদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য পামার ও পারকিন্স তাদের নিজ নিজ দেশের সরকারের চক্ষু ও কর্ণ বলে চিহ্নিত করেছেন।
পররাষ্ট্রনীতি :- ফ্রাঙ্কেলের মতে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক নির্ধারক হল জাতীয় স্বার্থ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্র নিঃস্বার্থভাবে অপর কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না।
মূলত জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান সম্পর্কে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।
প্রচার :- প্রচারের সাহায্যে একটি দেশ তার জাতীয় স্বার্থসমম্বিত পররাষ্ট্রনীতির অনুকূলে অন্যান্য দেশের মতামত গড়ে তোলে। পররাষ্ট্রনীতি রূপায়ণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হল রাজনৈতিক প্রচার। প্রচারের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র তার গৃহীত নীতিকে বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চায়।
জোট গঠন :- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার অন্যতম একটি উপায় বা পদ্ধতি হল জোট গঠন। মূলত জাতীয় স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রগুলি জোট গঠন করে থাকে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির জোট ন্যাটো এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে গঠিত ওয়ারশ জোটের কথা উল্লেখ করা যায়।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ঋণ :- অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলি তাদের জাতীয় স্বার্থ পুরণের লক্ষ্যে কাজ করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কৌশল হিসেবে উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলিকে অর্থনৈতিক সাহায্য ও ঋণ প্রদান করে থাকে। এভাবে উন্নত দেশগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন ইস্যুতে ঋণগ্রহীতা উন্নয়নশীল দেশগুলির সমর্থন অতি সহজেই অর্জন করতে সক্ষম হয়।
জাতীয় স্বার্থের উপাদান
ভৌগোলিক অখন্ডতা :-
দেশের প্রতিরক্ষা ও ভৌগোলিক অখন্ডতাকে নিয়ে জাতীয় স্বার্থের প্রধান উপাদান গঠিত হয়। অনেকে একে জাতীয় নিরাপত্তা বলে অভিহিত করেছেন। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটিও এর সঙ্গে জড়িত। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রেই নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ও ভৌগোলিক অখন্ডতা বজায় রাখার বিষয়টিকেই আধুনিক বিশ্বের দেশগুলি সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়।
আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান:-
জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে , তার সঙ্গে মেলবন্ধন করাই হল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিকে সামনে রেখে বিদেশনীতি অনুসরণের মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান করতে চায়।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন :-
অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। প্রতিযোগিতা - নির্ভর বিশ্ববাণিজ্যে নিজের স্থান অক্ষুন্ন রাখা, বহিঃবাণিজ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার অর্জন করা, অবাধ বাণিজ্য ও বিদেশি পুঁজি লগ্নির সুযোগ গ্রহণ করা - ইত্যাদি বিষয়ে সকল রাষ্ট্র বিপুল আগ্রহের সাথে তার জাতীয় স্বার্থ চরিতার্থ করে থাকে।
সাংস্কৃতিক বিনিময় :-
জাতীয় স্বার্থের উপাদান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বায়নের নয়া ব্যবস্থায় তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে এক দেশের সাথে অন্য দেশের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের বিষয়টি আরো সহজতর হয়েছে। সাংস্কৃতিক আদান - প্রদানের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করে জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্য পূরণ করতে চায় প্রতিটি রাষ্ট্র।
আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ :-
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি দেশ বিভিন্ন ধরণের আন্তর্জাতিক সংগঠনে কতখানি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারছে তার উপর সেই দেশের জাতীয় স্বার্থ পূরণের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই কারণে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। যেমন , সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ পূরণের বিষয়টি একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।
বিশ্ব জনমত :-
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হিসেবে বিশ্ব জনমতের কথা উল্লেখ করা হয়। আন্তর্জাতিক সংকটের মোকাবিলায় বিভিন্ন রাষ্ট্র বিশ্ব জনমত গঠনের মাধ্যমে নিজেদের জাতীয় স্বার্থপূরণের লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। এছাড়া ২০১১ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাই বিস্ফোরণের পর পাক সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের ভূমিকা উল্লেখ করা যায়।
উপসংহার
নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে একটি রাষ্ট্র উপরিক্ত উপায় গুলির মধ্যে যেকোন এক বা একাধিক উপায় অনুসরণ করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব যতদিন বজায় থাকবে, ততদিন জাতীয় স্বার্থের ধারণা কে কোনভাবেই বর্জন করা যাবে না। তবে বিশ্বশান্তি রক্ষা প্রতিটি দেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার প্রধান মাধ্যম হওয়া উচিত।
0 মন্তব্যসমূহ