ভারতের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি: (Election system of the President of India).

ভারতীয় শাসনব্যবস্থা সংসদীয় এবং রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থার সমন্বয়ে গঠিত হওয়ার ফলে এক অভিনব শাসনব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি তত্ত্বগতভাবে শাসন বিভাগের চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী হলেও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত একটি ক্যাবিনেটের পরামর্শে পরিচালিত হন বলে কার্যত তিনি নিয়মতান্ত্রিক বা নামসর্বস্ব শাসক হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছেন। তবে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি কিন্তু বেশ জটিল। ভারতের সংবিধানের ৫৪ ও ৫৫ নং ধারায় পরোক্ষ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। গণপরিষদে অনেকেই প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সরাসরি জনগণের কাছে রাষ্ট্রের প্রধানকে ভোট প্রার্থী প্রতিপন্ন করার সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত বা সম্মানজনক বলে সমীচীন হয়নি।

ভারতের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর যােগ্যতা

সংবিধানের ৫৮নং ধারায় রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর যােগ্যতার উল্লেখ আছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে গেলে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে নিম্নলিখিত যােগ্যতার অধিকারী হতে হয়।
 
যেমন—
• ভারতের নাগরিক হতে হবে।
• কমপক্ষে ৩৫ বছর বয়স্ক হতে হবে।
• লোকসভার সদস্য (M.P) হওয়ার যােগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে।
• কেন্দ্র ও রাজ্য আইনসভার কোনাে সদস্যপদে থাকতে পারবেন না।
• তিনি কোনােরকম সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না।
• রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নাম ৫০ জন নির্বাচক দ্বারা প্রস্তাবিত এবং ৫০ জন নির্বাচক কর্তৃক সমর্থিত হতে হবে।
• প্রত্যেক প্রার্থীর মনােনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ১৫,০০০ টাকা ফি-বাবদ জামানত হিসেবে দিতে হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে, সংবিধানের ৫৯ নং ধারানুযায়ী লোকসভা, রাজ্যসভা অথবা বিধানসভা কিংবা বিধান পরিষদ ইত্যাদি কোনাে কক্ষের সদস্য যদি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন তাহলে নির্বাচনের দিন তিনি শপথ গ্রহণ করবেন আর সেদিনই তিনি ওই সদস্যপদ ত্যাগ করেছেন বলে গণ্য করা হবে।



ভারতের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি
সংবিধানের ৫৪ নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি একটি বিশেষ নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে নির্বাচিত হন। 

কেন্দ্রীয় সংসদের উভয় কক্ষের (রাজ্যসভা ও লোকসভা) নির্বাচিত সদস্যদের ও অঙ্গ রাজ্যগুলির বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে এই নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়।

রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হতে গেলে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই হবে না, প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকের বেশি ভোট পেলেই রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়া যাবে। যে পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন হয়, তার সাংবিধানিক নাম হল 'একক হস্তান্তরযোগ্য জোটের মাধ্যমে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব'।
বিশেষ পদ্ধতিতে সংসদ ও বিধানসভার সদস্যদের ভোটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। 

প্রথম পর্যায়
প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের বিধানসভার সদস্যদের একটি করে ভোট থাকে। কিন্তু এই ভোটের মূল্য বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন মানের হয়। কারণ, বিভিন্ন রাজ্যের জনসংখ্যা ও বিধানসভায় তাদের প্রতিনিধির সংখ্যা এক নয়।

সর্বশেষ জনগণনার ভিত্তিতে রাজ্যের জনসংখ্যাকে বিধানসভার নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হয়। সেই ভাগফলকে আবার ১০০০ দিয়ে ভাগ করা হয়। এই ভাগফলের সংখ্যাই হবে সেই রাজ্যের বিধানসভার প্রত্যেক সদস্যের ভোট মূল্য। কিন্তু ভাগশেষ যদি ৫০০ বা তার বেশি থাকে তবে ভাগফলের সঙ্গে ১ যোগ করে প্রত্যেক সদস্যের ভোট সংখ্যা ১ বাড়াতে হবে। 

দ্বিতীয় পর্যায়
কেন্দ্রীয় সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচিত সদস্যদের ভোটের মূল্য = সব রাজ্যের বিধানসভার সদস্যদের ভোটের মোট মূল্য / সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচিত সদস্যদের মোট সংখ্যা। সদস্যদের প্রত্যেকের ভোটের মূল্য যাই হোক না কেন, তাঁরা কিন্তু ভোট দেবেন একটিই।

উদাহরণ স্বরূপ —
ধরা যাক, কোনো বিধানসভার সদস্যদের প্রত্যেকের ভোটের মূল্য হল ১২৩০টি। তিনি কিন্তু এই ১২৩০ টি ভোট ততবার দেবেন না। তিনি দেবেন একটি মাত্র ভোট। তিনি যে প্রার্থীকে ভোট দেবেন তাঁর সেই ভোটের মূল্য ধরা হবে ১২৩০। 
ভোটগ্রহণ
নির্বাচন হয় গোপন ব্যালটের মাধ্যমে। সমানুপাতিক নিয়ম অনুসারে ভোট গ্রহণ করা হয়। নির্বাচনে যত জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন প্রত্যেক নির্বাচক অর্থাৎ বিধায়ক ও সাংসদরা যতগুলিই 'পছন্দ' (Preference) ভোট দিতে পারেন। যদি ৫ জন প্রার্থী থাকেন তবে ভোটদাতারা প্রদত্ত ব্যালটপত্রে প্রার্থীদের নামের পাশে তাঁদের পছন্দ মত সংখ্যা বসাবেন। ভোটদাতা যাঁকে তাঁর প্রথম পছন্দের প্রার্থী বলে বিবেচনা করবেন, সেই প্রার্থীর নামের পাশে ১ সংখ্যা দিয়ে তাঁর পছন্দ জ্ঞাপন করবেন। অন্যান্য প্রার্থীদের নামের পাশে তিনি ২, ৩, ৪ প্রভৃতি সংখ্যা তাঁর পছন্দের সূচক হিসেবে বসাবেন। ভোটদাতাকে অবশ্যই তাঁর প্রথম পছন্দের কথা জানাতেই হবে। অর্থাৎ কোনো প্রার্থীর নামের পাশে ১ (এক) সংখ্যাটি বসাতেই হবে। অন্যান্য পছন্দগুলি তিনি নাও জ্ঞাপন করতে পারেন। প্রথম পছন্দটি জ্ঞাপন না করলে ভোটপত্রটি বৈধ বলে গণ্য হবে না। এরপর ভোট গণনার পর্বে সকল নির্বাচিত প্রার্থীর প্রথম পছন্দের বৈধ ভোটগুলির গণনা হয়। এই ভোট সংখ্যাকে ২ দিয়ে ভাগ করা হয়। ভাগফলের সঙ্গে ১ (এক) যোগ করা হয়। এই সংখ্যাকে বলে কোটা (Quota)। 

এই কোটা সংখ্যক ভোট যে প্রার্থী লাভ করবেন তিনি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হবেন। এমন হতে পারে যে, প্রথমবার গণনার পর কোন প্রার্থীই প্রথম পছন্দের (First Preference) কোটার ভোট পেলেন না। সেই ক্ষেত্রে  সবচেয়ে কম সংখ্যক প্রথম পছন্দের ভোট যিনি পেয়েছেন তাঁকে গণনা থেকে বাতিল করে দেওয়া হবে। সেই প্রার্থীর ব্যালটপত্র দ্বিতীয় পছন্দের ভিত্তিতে অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে হস্তান্তরিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কোনো প্রার্থী কোটা-সংখ্যক ভোট পেলে তিনি নির্বাচিত হবেন। সর্বনিম্ন প্রার্থীরা যদি সমান সংখ্যক ভোট লাভ করেন, তবে বাতিল প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবে লটারির মাধ্যমে। রাষ্ট্রপতির কোটা-সংখ্যক ভোট পেয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি একটি উদাহরণের মাধ্যমে উপস্থিত করা যায়।


উদাহরণ স্বরূপ —
মনে করা যাক যে, রাষ্ট্রপতি পদে ৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এই তিনজন প্রার্থী X, Y, Z. প্রথম পছন্দের বৈধ ভোটের সংখ্যা ১২০০। তাহলে, কোটা সংখ্যক ভোট হবে ১২০০+২ ÷ ২ = ৬০১ টি। X, Y, Z কেউ যদি এই ৬০১ টি ভোট অর্জন করতে না পারেন তবে তাঁদের মধ্যে কেউ নির্বাচিত বলে ঘোষিত হবেন না। ধরা যাক এঁদের মধ্যে সবচেয়ে কম 'প্রথম পছন্দের' 'Y' প্রতিদ্বন্দ্বী ৩০০ টি ভোট পেয়েছেন। 'Y' কে নির্বাচন থেকে বাতিল বলে ঘোষণা করা হবে। এরপর Y-প্রার্থীর ব্যালটপত্রে X ও Z যে দ্বিতীয় পছন্দের ভোট পেয়েছেন তা 'X' ও 'Z' এর প্রাপ্ত প্রথম পছন্দের ভোটের সঙ্গে যোগ করতে হবে।

ধরা যাক 'X' প্রথম পছন্দের ভোট পেয়েছেন ৫০০ টি। দ্বিতীয় পছন্দের ভোট পেয়েছেন ২০০ টি। মোট ৭০০ টি 'X' -এর পক্ষে গেছে। 'X' কোটা সংখ্যক ভোটের নিয়ম পূরণ করে নির্বাচিত ঘোষিত হবেন।


রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিরোধ মিমাংসা
রাষ্ট্রপতির নির্বাচন নিয়ে যদি কোনো বিরোধের অবতারণা হয়, তবে সে সম্পর্কে অর্থাৎ বিরোধ নিরসনের জন্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে হবে। সংবিধানের ৭১ নং ধারায় এ সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশ আছে। সংবিধানে একথাও বলা হয়েছে,  রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় থাকার সময় যে সমস্ত সরকারি কাজ করেছেন (সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার আগে পর্যন্ত) তা সুপ্রিম কোর্টের ঘোষিত রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাতিল বলে গণ্য হবে না।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে যদি কোন বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হয়, সেই পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিধায়করা ভোট দানে বঞ্চিত হবেন। এই পরিস্থিতিতেও সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যা (১৯৭৪) অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো বাধা পড়বে না। সংসদের কোনো অলিন্দ কোন কারণে শূন্য থাকলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ব্যাহত হয় না।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটের মূল্য প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে প্রতি বিধায়কের ভোটের মূল্য সবচেয়ে বেশি হচ্ছে উত্তরপ্রদেশে — ২০৮। এর সবচেয়ে কম মূল্য হচ্ছে সিকিম রাজ্যে — মাত্র ৭। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বিধায়কের ভোটের মূল্য ১৫১।
পশ্চিমবঙ্গে বিধায়ক সংখ্যা ২৯৪ ও এই হিসাবে রাজ্যের মোট ভোটের মূল্য ৪৪৩৯৪।

সমগ্র জাতি ও রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে রাষ্ট্রপতি সর্ব রাজ্যের প্রতিনিধিত্বের ইমেজ। এই রূপকল্প ধরে রাখতেই রাষ্ট্রপতি সরাসরি অন্যান্য জন প্রতিনিধিদের মতো নির্বাচিত হন না। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তাঁর সর্বরাজ্য পরিচয়ই প্রধান। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন তাই সাধারণত সাধারণ প্রকাশ্য দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে।



রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতির ত্রূটি

(১) রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মতানুসারে, ভারতের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতিকে কখনােই সমানুপাতিক বলা চলে না কারণ, কমপক্ষে দুটি আসন ছাড়া সমানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি প্রয়ােগ করা সম্ভব নয়। এরজন্যই এম পি শৰ্মা তাঁর 'The Government of the Indian Republic' গ্রন্থে মন্তব্য প্রকাশ করেছেন যে, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি সমানুপাতিক না বলে নির্বাচন পদ্ধতিকে বিকল্প বা পছন্দমাফিক’ ভাট ব্যবস্থা বলাই ভালাে।


(২) এই নির্বাচন প্রক্রিয়াটির আর-একটি ত্রুটি হল এই প্রক্রিয়াটি অতিমাত্রায় জটিল, কারণ পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে কোনাে দল যদি একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় এবং বহুদলীয় ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বহু প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়, তাহলে এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন জটিল হয়ে যায়।


    রাষ্ট্রপতি পদে থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে কোনাে আইনি প্রশ্ন তােলা যায় না, তাঁর কাজের জন্য আদালতে জবাবদিহি করতে হয় না। তাই এককথায় বলা যেতে পারে যে, কার্যত ভারতের রাষ্ট্রপতি কি আইনের উর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে।

0 মন্তব্যসমূহ