খলজি রাজবংশ ও আলাউদ্দিন খলজী: (Khilji Dynasty and Alauddin Khilji).

 

খলজী রাজবংশ (১২৯০-১৩২০খ্রীঃ):

  • খলজিরা ছিল তুর্কী। দীর্ঘ ২০০ বছর এই অঞ্চলে বসবাসের ফলে তার আফগান ভাবধারা, সংস্কৃতি ও আচার আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এই কারণে আদি তুর্কীরা তাদের তুর্কী বলে মানতে অস্বীকার করত। 
  • গজনির সুলতান মামুদ ও মহম্মদ ঘােরীর সেনাবাহিনীতে প্রচুর খলজি যােগ দেয়। তরাইনের প্রথম যুদ্ধে জনৈক খলজি সেনা আহত মহম্মদ ঘুরীর প্রাণ রক্ষা করেন। 
  • তুর্কী কথায় খলজী শব্দের অর্থ হল যােদ্ধা। 
  • খলজিরা সিংহাসন আরােহণের পর তুর্কী, তাজিক, ভারতীয় মুসলমান, হিন্দু সকলকে শাসকগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করেন। 

জালালউদ্দিন খলজি (১২৯০-১২৯৬): 

জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজির উপাধি ছিল ইবনে সইফ অর্থাৎ তরবারের ছেলে এবং শায়েস্তা খাঁ। মালিক ফিরোজ খলজি কাবিলে তুর্কি ছিল। তিনি নিজের ভাই শিহাব উদ্দিন এবং তার পুত্র আলি গুর্শপকে নিয়ে অনেকদিন ধরেই বলবনের সেবা করেছিলেন। তিনি  জালাল উদ্দিন বলবনের "সার-ই-জান্দার" ছিলেন। এরপর তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের প্রধান রক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং মোঙ্গলদের সঙ্গে সফলতা পূর্বক লড়াই করেছিলেন। কায়কোবাদ জালাল উদ্দিন খলজিকে মুমালিকের পদ দেন।

          জালাল উদ্দিন ৭০ বছর বয়সে সিংহাসনে সুলতান হিসাবে আহরণ করেন যা সুলতানি ইতিহাসে সর্বাধিক বৃদ্ধ বয়সের সুলতান। সুলতান জালালুদ্দিন পাগড়ি ধারণ করতেন। নয়ন জৈনি জালালুদ্দিন খিলজীর অধিকারী ছিল। 

আলাউদ্দিন খলজী (১২৯৬-১৩১৬): 

আলাউদ্দিন খলজির মূল নাম ছিল আলী বা আলী গুর্শপ। ১২৬৬ সালে শীর্শাতে তার জন্ম হয়। আলাউদ্দিন খলজী গজনীর জামা মসজিদের খুতবা পড়েছিলেন। বিশ্বের সুলতানি যুগের বিজেতা এবং পৃথিবীর শাসক বলে আলাউদ্দিন খলজি কে সম্বোধন করেছেন আমির খসরু। মোহাম্মদ হাবিব এর অনুসারে-মধ্যকালীন ভারতের(Medieval India) রাজনৈতিক ইতিহাসের শুরু আলাউদ্দিন আলাউদ্দিন খলজী কে দিয়ে। 

আলাউদ্দিন খলজির সেনাপতি জাফর খাঁকে সেই যুগের রুস্তম বলা হত। মালিক নায়ক নামে একজন হিন্দু সেনা আলাউদ্দিন খলজির সেনাবাহিনীতে ছিলেন, যাকে দেখে মোঙ্গলরা ভয় পেতেন এবং তিনি মোঙ্গলদের হারিয়ে ছিলেন। দিল্লির সুলতানি যুগের সর্বাধিক মোঙ্গল আক্রমণ আলাউদ্দিন খলজির সময়কালে হয়েছিল। অধিকাংশ ইতিহাসকারকের মতে আলাউদ্দিন খলজির আমলে মোট ৬ বার মোঙ্গল আক্রমণ হয়েছিল। 

আলাউদ্দিন খলজির আমলে বাজার ব্যবস্থা ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে চিতোর বিজয়ের পর আলাউদ্দিন খলজির বাজার ব্যবস্থা নিয়ম চালু করেন। বাজার ব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণ বরণির "তারিখ-ই-ফিরোজশাহীতে" পাওয়া যায়। বরণির অনুসারে মোঙ্গলদের আক্রমণ রুখতে আলাউদ্দিন খলজি কে বিশাল পরিমাণ সেনাবাহিনী রাখতে হতো এবং এই সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ যাতে খুব কম বেতনে পরিপূর্ণ করা যায় তার জন্য তিনি এই বাজার ব্যবস্থা চালু করেন। 

আলাউদ্দিন খলজির আমলে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলি হল- 

i) তার আমলেই সর্বাধিক পরিমাণে খালসা জমির বিস্তার হয়েছিল। 

ii) ঘোড়ার চিহ্নিতকরণ এবং সৈনিকদের হুলিয়া প্রথা সর্বপ্রথম প্রচলন আলাউদ্দিন খলজী করেছিল।

iii) আলাউদ্দিন খলজী প্রথম সুলতান ছিলেন যিনি বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ করার চেষ্টা করেন। 

iv) আলাউদ্দিন খলজি জৈন কবি রামচন্দ্র শুরিকে সম্মানিত করেছিলেন। 

 

             আলাউদ্দিন খলজির পর খলজি বংশের পরবর্তী শাসক হিসাবে শিহাব উদ্দিন ওমর, কুতুব উদ্দিন মোবারক, নাসিরুদ্দিন বাহারামশাহ খলজি বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে দিল্লির সুলতানি সিংহাসনে বসেন। 

মালিক কাফুর:

মালিক কাফুর একজন ভারতীয় খােজা যিনি আলাউদ্দিন খলজির সৈন্যদলের সৈন্যাধ্যক্ষ হয়েছিলেন। ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে এক হাজার দিনারে নসরত খান তাকে ক্রয় করেন। এই কারণে তাকে হাজার দিনারিও বলা হত। কথিত আছে যে আলাউদ্দিন তার সুদর্শন চেহারায় আকৃষ্ট হয়ে তাকে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণে সম্মত হওয়ায় সেনাবাহিনীতে কমান্ডার হিসাবে নিয়ােগ করেন। আলাউদ্দিনের প্রিয়পাত্র। হয়ে ওঠায় তিনি অতি দ্রুত সেনাবাহিনীতে উচ্চপদ লাভ করেন। তিনি দেবগিরির যাদব রাজ, কাকতীয় রাজ্য, দক্ষিণ ভারত জয়ে তিনি সুলতানের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। কাফুরের দক্ষিণ – ভারতের পাণ্ড্য রাজ্য জয় দক্ষিণ ভারতে মুসলিম রাজ্য বিস্তারলাভ করে। কাফুরের দক্ষিণ ভারত জয়ের ফলে আলাউদ্দিন তার হাতের পুতুল হয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন সুলতানের কুচক্রী এক রত্ন এবং ফলে সুলতানের বেগম এবং পুত্রেরা ষড়যন্ত্র করতে থাকে এবং পরিশেষে তাদের বন্দি করা হয়। সিংহাসনের দাবিদার সম্রাটের সন্ত্রান্ত বংশধরদের অভিযুক্ত করার জন্য দায়ী ছিলেন। কাফুর স্বয়ং আলাউদ্দিনের মৃত্যুর ছত্রিশদিন পর কাফুর এবং তার সঙ্গীদের হত্যা করা হয়। 

আমির খুসরু:

আবুল হাসান ইয়ামিন আল দিন খসরু আমির খসরু দেলভি নামেই সুপরিচিত, ভারতীয় সংস্কৃতি ইতিহাসে তিনি অনুকরণ যােগ্য হয়ে আছেন। দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার তিনি আতীন্দ্রীয়বাদী। সুফি এবং আধ্যাত্মিক শিষ্য ছিলেন। তিনি কেবলমাত্র কবিই ছিলেন না তিনি ছিলেন হিন্দুস্থানি মুসলিম কাওয়ালি উচাঙ্গ সংগীতের প্রবর্তক। তিনি দিল্লির সাতজন সুলতানের সভাকবি ছিলেন। তিনি ভারতীয় , আরবি ও পাশি সংগীতের মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। তিনি তুরস্কীয় পিতা সৈফ আদ – দিন এবং ভারতীয় মাতার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তবলা এবং সেতার আবিষ্কার করেন এবং উন্নতমানের বীণার আবিষ্কারক হিসাবে সাফল্যলাভ করেন। তিনি তুতি – ই – হিল (ভারতীয় তােতা) খেতাব লাভ করেন। 


আলাউদ্দিন খলজীর শাসন ব্যবস্থা:

👉কেন্দ্রীয় শাসন: 

আলাউদ্দিন খলজীর অভ্যন্তরীণ নীতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীয়করণ করা এবং সাম্রাজ্যের সুরক্ষার জন্য সেনাবাহিনী গঠন করা। আলাউদ্দিন শাসনব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব স্বীকার করতেন না। ইতিপূর্বে শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে উলেমা, কাজী প্রমুখ ধর্মীয় ব্যক্তিগন হস্তক্ষেপ করতেন। কিন্তু আলাউদ্দিন ইসলামী নীতি ও শরিয়তের নিয়ম অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনার পক্ষপাতী ছিলেন না। আলাউদ্দিন বুঝতে পেরেছিলেন বহু ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও সংস্কৃতির দেশ হলো ভারত, তাই এই দেশে নির্দিষ্ট ধর্মীয় শাসন প্রয়োগ করা সঠিক হবে না। একারণেই রাষ্ট্রনীতি থেকে ধর্মনীতিকে পৃথক করে রাখতে চেয়েছিলেন। শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখ নিরপেক্ষ এবং সুলতানের সিদ্ধান্ত ছিল সর্বশেষ কথা। সুশাসন প্রবর্তন করার জন্যে আলাউদ্দিন বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। 

👉নিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা: 

তিনি উলেমা ও অভিজাতদের রাজনৈতিক প্রভাব খর্ব করে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। আমীর-ওমরাহোদের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করে দেন। প্রশাসনিক ক্ষমতা থেকে উলেমাদের সরিয়ে ধর্ম-নিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রচলন করেন। 

👉গুপ্তচর নিয়োগ:

তিনি গুপ্তচর বাহিনীকে শক্তিশালী করেছিলেন, যারা সুলতানের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল। এই গুপ্তচর বাহিনী রাজকর্মচারী ও অভিজাতদের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতো। এরফলে কেন্দ্রীয় শাসন সুদৃঢ় হয়। 

👉শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন: 

আলাউদ্দিন বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন এবং সামরিক বিভাগের বেশকিছু পরিবর্তন করেছিলেন। সেনাকর্মীদের জায়গির দেওয়ার প্রথা বন্ধ করে নগদ বেতন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। সেনাবাহিনীতে দূর্নীতি বন্ধ করার জন্য দাগ (ঘোড়ার পিঠে চিহ্নিতকরণ) ও হুলিয়া (সৈনিকদের বিবরণ) প্রথা চালু করেন। 


👉কর্মচারী নিয়োগ: 

শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য আলাউদ্দিন খলজী অনেক সরকারি কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। রাজস্ব বিভাগের প্রধান ছিলেন দেওয়ান-ই-আসরাফ। সামরিক বিভাগের প্রধান ছিলেন আরিজ-ই-মামলিক। সেনাবাহিনীর বেতন ও ভাতা নিয়ন্ত্রণের জন্য বখসী-ই-ফৌজ নিয়োগ করেন। বিচার বিভাগের দ্বায়িত্বে ছিলেন কাজী-উল-মামালিক। এছাড়াও কৃষি বিভাগ ও বাজার তত্ত্বাবধানের জন্য  আমীর-ই-কোহী ও শাহান-ই-মণ্ডী নিযুক্ত করেন। 

👉বিচার ব্যবস্থা:

শাসনকার্যের সুবিধার জন্য আলাউদ্দিন তাঁর রাজ্যকে ১১টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রতিটি প্রদেশের দ্বায়িত্বে ছিলেন একজন করে মালিক। সুলতান গুপ্তচর বাহিনীর মাধ্যমে প্রদেশের সমস্ত খবরাখবর সংগ্রহ করতেন। সুলতান ছিলেন বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক। সুলতানকে সাহায্য করতেন প্রধান কাজী, মুফতি প্রমুখ কর্মচারী। এইসব কর্মচারীগণ কঠোরভাবে আইনবিধি পালন করতেন। 


👉রাজস্ব সংস্কার:

সুলতান সমস্ত রকমের জায়গীর বাজেয়াপ্ত করেন এবং সাধারণ প্রজাদের মতো কর্মচারীদের ওপর কর ধার্য করেন। সমস্ত দানকরা জমিকে খাসজমি বা খালিসাতে পরিনত করেন। স্থানীয় প্রধানরা কৃষকদের কাছ থেকে যাতে সুলতান নির্ধারিত ফসলের চেয়ে বেশি ফসল আদায় না করতে পারে তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর ফলে কৃষকরা খুৎ, মুকাদ্দম ও চৌধুরী প্রমুখ মধ্যস্বত্বভোগীদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পায়। এমনকি কৃষকদের অবস্থা জানার জন্য সুলতান সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন। 

👉বিভিন্ন কর ও জমি জরিপ: 

রাজকোষের ঘাটতি পূরণ করার জন্য আলাউদ্দিন বাড়তি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন। গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলে অবস্থিত গ্রামগুলি ইকবাল হিসেবে আমীর-ওমরাহদের না দিয়ে রাজস্ব আদায়ের ভার সরকার নিজের হাতে রাখেন।  ভূমিরাজস্ব হিসেবে কৃষকদের উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক কর ধার্য করা হয়। এতকাল পর্যন্ত অনুমানের ভিত্তিতে ভূমিরাজস্ব আদায় করা হতো। কিন্তু আলাউদ্দিন এই রীতি পরিবর্তন করে জমি জরিপের ব্যবস্থা করেন। সমস্ত জমি জরিপ করিয়ে তার ভিত্তিতে রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি চালু করেন। ভূমিরাজস্ব ছাড়াও  আরও কিছু কর আদায় করা হতো, যেমন ভিটা কর ও গোচারণ কর প্রভৃতি। স্থানীয় প্রধানদের উপরেও এই সমস্ত কর ধার্য ছিল। রাজস্ব আদায়ের পারিশ্রমিক হিসেবে তাদের নগদ বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সুলতানের এই রাজস্ব সংস্কারের ফলে সরকারের আয় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

আলাউদ্দিন খলজীর মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি:

👉বাজারদর বা মূল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য:

আলাউদ্দিন খলজীর অন্যতম বিখ্যাত সংস্কার ছিল মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি। চিতোর জয়লাভ করার পর আলাউদ্দিন কঠোরভাবে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করেন। আলাউদ্দিনের এই সংস্কারের উদ্দেশ্যে সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছে। বরনীর মতে, আলাউদ্দিন তাঁর অশ্বারোহী সেনাদের ২৩৪ টঙ্কা (মতান্তরে ২৩৮ টঙ্কা) বার্ষিক বেতন দিতেন। যাতে এই বেতনে অশ্বারোহী সেনারা তাদের সরঞ্জাম, অস্ত্র, ঘোড়া রাখতে পারে এবং পরিবার প্রতিপালন করতে পারে, এজন্য আলাউদ্দিন জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেন। বিরাট সেনাদল রাখতে আলাউদ্দিনের সব জমানো টাকা খরচ হয়ে যায়। সুতরাং সেনাদের বেতন বৃদ্ধি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এজন্যই তিনি মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন। তিনি আরও বলেছেন প্রধানত হিন্দুদের জব্দ করার জন্য তিনি এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কারণ তখন খাদ্যশস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবসায় হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল বেশি। তাই মূল্য নিয়ন্ত্রণের ফলে হিন্দুরাই সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে সতীশচন্দ্র প্রমুখ অনেকেই মনে করেন এমন ধারণা ভিত্তিহীন।কারণ পশ্চিম ও পূর্ব এশিয়ার স্থলপথে বর্হিবাণিজ্যে সুলতানি ও খোরাসানী বণিকদের প্রাধান্য ছিল। এদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণের ফলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্রের মতে, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে অশ্বারোহী সেনারা ছিল উচ্চ শ্রেণীর লোক। সুতরাং তাদের জীবনযাত্রার মান ছিল উঁচু। আলাউদ্দিন ভেবেছিলেন যে ২৩৪ টঙ্কা বেতনে তাদের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব নয়। এই কারণে খাদ্য ও অন্যান্য জিনিস সরবরাহের উদ্দেশ্যে তিনি মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন। তবে বাহিনীর সুবিধার জন্যই কেবল আলাউদ্দিন বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন এই অভিমত অনেকেই গ্রহণ করেন নি। সুফি সন্ত শেখ নাসিরউদ্দিন চিরাগের মতে, জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন এই সংস্কার করেছিলেন। কারন সুলতান মনে করতেন ন্যায্যমূল্যে প্রয়োজনীয় জিনিস জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া নৈতিক কর্তব্য। কিন্তু গবেষক কে এস লাল মনে করেন সুফি সন্তের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় কারণ তা সুলতানের দরবারে পাঠের জন্য রচিত হয়েছিল। ডক্টর ইউ এন দে বলেছেন, আলাউদ্দিনের সময়কালে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছিল। সুলতান এই মুদ্রাস্ফীতি রোধ এবং খাদ্যশস্যের যোগান অব্যাহত রাখার জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণ বা মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন। 

👉ন্যায্যমূল্যের বাজার প্রতিষ্ঠা: 

আলাউদ্দিন দিল্লিতে কয়েকটি ন্যায্যমূল্যের বাজার প্রতিষ্ঠা করেন, যেমন- মান্ডি বা শস্য সেরা আদল। সেরা-ই-আদল বা ফল এবং বস্ত্র বাজার, পশু ও দাস বাজার, অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেন। চালের দাম ছিল প্রতিমণ ৫ জিতল, গমের দাম ছিল প্রতিমণ সাড়ে সাত জিতল। একটি সুন্দরী যুবতী দাসীর দাম ছিল ১০০ বা ১২৫ টঙ্কা। একটি ভালো আরবি ঘোড়ার দাম ছিল ১২৫ টঙ্কা বা তারও বেশি। যাতে ধনী লোকেরা সব খাদ্য সস্তায় পেয়ে কিনে না নেয় এজন্য কোনো পরিবারকে ১/২ মনের বেশি খাদ্যশস্য কিনতে অনুমতি দেওয়া হতো না। দেওয়ান-ই-রিয়াসৎ নামক কর্মচারী তাঁর দপ্তরের লোকেদের দ্বারা মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং ওজন প্রভৃতির তদারক করতেন। শাহানা-ই-মাণ্ডি নামক কর্মচারী বাঞ্জারা বা পাইকারী ব্যবসায়ী এবং খুচরো দোকানদারের কাছে জামিন নিয়ে তাদের নির্ধারিত মূল্যে সরবরাহ ও বিক্রয়ের আদেশ দেন। এই কর্মচারী বহু পরিশ্রমে বিক্রয় যোগ্য দ্রব্যের মূল্য তালিকা স্থির করতেন। যাতে তা পালিত হয় তার জন্য লক্ষ্য রাখতেন। আইন ভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। আলাউদ্দিনের এই মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি দিল্লির বাইরে অন্য শহরে চালু ছিল কিনা সঠিক জানা যায় না। দিল্লির জনসাধারণ মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির ফলে সস্তা দরে খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য জিনিস কিনতে পারতো। 

সমালোচনা:

আলাউদ্দিনের শাসন ব্যবস্থা দিল্লি সুলতানিকে সুসংহত ও সুদৃঢ় করেছিল। তাঁর দৃঢ়তার কারণেই দেশ অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহজনিত সংকট থেকে রক্ষা পেয়েছিল। আলাউদ্দিনের রাজস্বব্যবস্থার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ইরফান হাবিবের মতে, " আলাউদ্দিন তাঁর রাজস্বব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামীণ দুই শ্রেণীর মধ্যে শক্তিশালীর বিরুদ্ধে দূর্বলকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছিলেন। " একথা বহুলাংশে সত্য হলেও কৃষকদের ওপর শোষণ সার্বিকভাবে বন্ধ করা সম্ভব হয় নি। কারণ তিনি কর্মচারীদের দূর্নীতি রদ করতে পারেননি। ডক্টর কে এস লাল এর মতে আলাউদ্দিন উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি না, রেখে কমদামে জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেওয়ায় বাণিজ্যের ক্ষতি হয়। তাই তাঁর মৃত্যুর পর এই ব্যবস্থা লোপ পায়। ডক্টর নিজামী প্রভৃতি গবেষক মনে করেন যে আলাউদ্দিন উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই দাম বেঁধে দেন। যাই হোক তার এই ব্যবস্থায় বহুলোক উপকৃত হয় এতে সন্দেহ নেই। 


0 মন্তব্যসমূহ