পরিবেশ আন্দোলন ও পরিবেশ দুর্ঘটনা:

 



• সাইলেন্ট ভ্যালি পরিকল্পনা: কেরলে পালঘাট জেলায় ক্রান্তিয় বৃষ্টি অরণ্যে ঢাকা উপত্যকার নাম হল সাইলেন্ট ভ্যালি। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই অরণ্যের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত কুন্তি নদীতে বাঁধ নির্মাণের উদ্দেশ্যে কেরল রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এই প্রকল্প রূপায়িত হলে সাইলেন্ট ভ্যালি বৃষ্টি অরণ্যের প্রায় ৮০০ হেক্টর বনভূমি বিনষ্ট হবে। মােট বনভূমির প্রায় ১০ শতাংশ এলাকা বাঁধের জলাধার, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কারখানা, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি তৈরি করতে নষ্ট হয়ে যাবে।

 

• সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলন: সাইলেন্ট ভ্যালি অঞ্চলের বৃষ্টি অরণ্যকে বাঁচানাের ও রক্ষা করার জন্য ১৯৭৮ সালের কেরলের একটি স্বেচ্ছাসেবী বিজ্ঞান সংস্থা, কেরল সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে যে আন্দোলন শুরু হয় তাই সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলন নামে পরিচিত। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রকল্পটিকে স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। 


• গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান: ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গঙ্গা নদীর দূষণের উপর একটি বিস্তৃত সমীক্ষা ও পর্যালােচনা করে দেখেন যে, গঙ্গা নদীর জল রীতিমতাে দূষিত হয়ে পড়েছে। তাই ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে Central Ganga Authority নামে একটি সংস্থা। গড়ে তােলা হয় এবং জুনে পরিবেশ ও বনমন্ত্রকের অধীনে গঙ্গা প্রােজেক্ট ডাইরেক্টরেট গঠন করা হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সপ্তম পরিকল্পনাকালে ১৯৮৬ সালের ১৪ জুন বারাণসীতে আনুষ্ঠানিকভাবে গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন করেন। 


• চিপকো আন্দোলন: ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে উত্তরপ্রদেশের গাড়ওয়াল জেলার মণ্ডল গ্রামে গাছ কাটার বিরুদ্ধে একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সৃষ্টি হয়। এটি চিপকো আন্দোলন নামে খ্যাত। ঠিকাদাররা গাছ কাটতে এলে গ্রামবাসী মহিলা ও শিশুরা গাছ জড়িয়ে ধরত। এর জন্য ঠিকাদাররা গাছ কাটতে পারত না। গান্ধীবাদী নেতা শ্রীসুন্দরলাল বহুগুণা এবং শ্রীচণ্ডীপ্রসাদ ভাট এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। 


• গ্রিন পিস আন্দোলন: ১৯৭১ সালের নেদারল্যান্ডের আমস্টারডমে পরিবেশ সুরক্ষার উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা স্থাপন করা হয়। এই সংস্থাটি গ্রিন পিস ইন্টারন্যাশনাল বা গ্রিন পিস নামে পরিচিত। গ্রিন পিস - এর লক্ষ্য হল— জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা, পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধ করা, পরিবেশের ক্ষতি রােধ করার জন্য জনমত গড়ে তােলা, পরিবেশের সুরক্ষার স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদি এবং শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। 


• স্টকহােম সম্মেলন: ১৯৭২ সালের ৫-১৬ জুন সুইডেনের স্টকহােম শহরে রাষ্ট্রসংঘের মানব পরিবেশ সংক্রান্ত প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভারত - সহ পৃথিবীর ১১৩ টি দেশ এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। স্টকহোেম সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার ক্ষতি প্রতিরােধ এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সুসংহত কর্মসূচি গ্রহণ করা। 


• নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন: গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে নর্মদা প্রকল্পের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ৩০ টি বড়াে বাঁধ, ১৩৫ টি মাঝারি বাঁধ এবং ৩০০০ টি ছােটো বাঁধ নর্মদা ও তার উপনদীগুলির উপর নির্মাণ করার পরিকল্পনা হয়। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ খরাপ্রবণ অনাবাদী। জমিগুলিকে সেচের আওতায় আনা এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানাে। এই প্রকল্পটি পরিবেশবাদীদের কাছে গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। কারণ এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে ৯২ টি গ্রাম সম্পূর্ণ জলমগ্ন হবে এবং ২৯৪ টি গ্রাম আংশিক জলমগ্ন হবে। প্রায় এ লক্ষের মতাে মানুষ কর্মহারা ও বাস্তুহারা হবে। ৫৪ হাজার হেক্টরের মতাে জমির উপর বনভূমির আচ্ছাদন বিনষ্ট হবে চিরকালীন। ফলে এক ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। মেধা পাটেকর এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জনগণকে নিয়ে যে সংগ্রাম গড়ে তুলেছেন তাই নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন নামে পরিচিত। 


• বসুন্ধরা সম্মেলন: রাষ্ট্রসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৯৯২ সালের ৩-১৪ জুন ব্রাজিলের রিও - ডি - জেনিরােতে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে পর্যালােচনা করার জন্য বসুন্ধরা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে ভারতসহ ১৩০ টি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। এই সম্মেলনের পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যা এবং তার নিয়ন্ত্রণের জন্য ২১ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এটি এজেন্ডা ২১  নামে পরিচিত। 


• চেনোবিল দুর্ঘটনা: চেনোবিল ইউক্রেনের একটি শহর। ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল এখানে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটে। পারমাণবিক চুল্লির ভিতরে ইউরেনিয়াম জ্বালানি খুব গরম হয়ে যায় এবং বিস্ফোরণ ঘটে। এর ফলে প্রায় ৩০০০ বর্গ কিলােমিটার অঞ্চল সঙ্গে সঙ্গে তেজস্ক্রিয়তার বিষে আক্রান্ত হয় এবং কাছাকাছি ইউরােপের দেশগুলিতে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। 


• ভােপাল গ্যাস দুর্ঘটনা: ১৯৮৪ সালের ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভােপালে ইউনিয়ন কার্বাইড কোম্পানির কীটনাশক পদার্থ প্রস্তুত করার কারখানায় ‘MIC' গ্যাস ভর্তি দু - তিনটি ট্যাঙ্কে বিস্ফোরণ ঘটে। ৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে 0° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শীতল করে রাখা মিক গ্যাস ভর্তি ট্যাঙ্কের রেফ্রিজারেটর যন্ত্র বিকল হয়ে যায়। ফলে এই মিথাইল আইসােসায়ানেট ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং বিস্ফোরণ ঘটায়। এই গ্যাস উদ্বায়ী, দাহ্য এবং অত্যন্ত বিষাক্ত, সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রায় ২৯০০ জন লােক নিহত এবং অসংখ্য লােক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে।

0 মন্তব্যসমূহ